প্রচ্ছদ প্রবন্ধ “শরতের উৎসব এবং দশভূজা দূর্গা”

“শরতের উৎসব এবং দশভূজা দূর্গা”

0
জিয়াউর রহমান সাকলাইন: কিছু সত্য আমরা সবাই জানি। যেমন যদি প্রশ্ন করা হয় কারা সবচেয়ে বেশি অতিথিপরায়ন? অথবা যদি বলা হয় কারা সবচেয়ে বেশি উৎসব প্রিয়? কিংবা যদি বলা হয় কাদের মাঝে মানবিকতা আত্মিক সম্পর্ক রাখার প্রবণতা বেশি? এসব কিছুরই সহজ সুন্দর উত্তর বাঙ্গালী জাতি, সোজা কথায় বাংলাদেশীরা। বাঙ্গাল, বাঙ্গালী ,বাংলাদেশী এ শব্দগুলো নিয়ে বিভিন্ন জনের বিভিন্ন মতামত। এসব নিয়ে তর্কের আসলেই কতটুকু প্রয়োজন আমি জানিনা; যে তর্ক গুলো বিভেদ তৈরি করে , যে তর্কের কোনো সুন্দর সমাধান নেই সেখানে যত কম প্রবেশ করা যায় ততই বোধহয় সবার জন্য ভালো, এটা আমি মনে করি!
আসলে এইসব বিষয় নিয়ে কথা বলতে আমার এই লেখাটা নয়, আমি আজ আবার উৎসব নিয়ে আমার ব্যক্তিগত কিছু কথা লিখতে চাই। আবার শব্দটা এই কারনে যে আমি আগে আরেকবার লিখেছিলাম এই বিষয়ে ।উৎসব প্রিয় এই জাতির জন্য আমার ক্ষুদ্র নিবেদন । উৎসব নিয়ে কমবেশি সুখস্মৃতি বা অন্য কোনো স্মৃতি সবারই আছে। ঈদ পূজো অথবা নববর্ষ। এসবইতো উৎসব। বিয়ে শাদি বা জন্মদিন এগুলো তো উপলক্ষ। যদিও বাংলাদেশে এসব উৎসব পালনে যতটা আনন্দ এই বিলেতে হয়তো ততটা হয়না, তারপরও এই বিলেতে সবাইকেই দেখি তার মত করেই উৎসবটা পালন করছে মহাআনন্দ নিয়ে। সে ঈদ, পূজা অথবা নববর্ষ । এবং সেটা সব ধর্মের লোকেরা মিলেমিশেই করছে।

বিলেত এবং বাংলাদেশ দুজায়গাতেই এখন শরৎকাল। দুজাগারই দুইরকম রূপ এই শরতের। বাংলাদেশের শরতের বর্ননাতে পড়েছিলাম কাশফুল আর আকাশে সাদা মেঘের ভেলা, প্রকৃতির শুভ্রতার বর্ননা ।আর এই বিলেতে দেখছি শীতের দীর্নতার আভাষ নিয়ে আসে অ্যাটাম মানে শরৎ। পাতা ঝরার এক বিবর্ন খেলা। সাথে দিনের আলো আর রাতের অন্ধকারের লুকোচুরি। বাংলাদেশে অবশ্য এই শরতের সাথে আরেকটা রূপ জড়িয়ে আছে, উৎসবের রূপ! রবি ঠাকুরের শারদোৎসব । দেবি দূর্গার আগমনের বার্তা আর বিসর্জনের ব্যথা। দূর্গোৎসব ।
দূর্গোৎসব নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষন ইতিহাস বর্ননা, বা এর শুরু শেষ কিছুই আমার জানা নেই। আমি শুধু জানি আমার শৈশব, যৌবন এবং এই প্রবাস জীবন গভীর ভাবে জড়িয়ে আছে এই উৎসবের সাথে। সেই ঢাকের আওয়াজ , ধূপ ধুনার গন্ধ, জবাফুলের মালা অথবা রঙ্গনের মালা সবকিছুই চোখ বন্ধ করলে দেখতে পাই। ঢেলা খিচুড়ি, মিষ্টান্ন , নারকেলের নাড়ুর স্বাদ এই জিহ্বা কখনোই ভুলবেনা। ভোরবেলার শরতের শিউলির সাথে দেবি দূর্গার রূপ এই চোখে লেপ্টে আছে এখনো।
আমার জন্ম এক রক্ষনশীল মুসলিম পরিবারে এবং আমাদের পাড়াও ঠিক একই রকমভাবে কঠিন ধর্মপরায়ন । কিন্তু আমি হলপ করে বলতে পারি আমাদের পাড়াতে যে ঘোষ বাড়ি আছে তাদেরকে কেউ কখনো অন্য চোখে দেখেছে।বরঞ্চ বিভিন্ন সময়ে তাদেরকে নিরাপত্তা দেয়া হয়েছে।খেয়াল রাখা হয়েছে যাতে তারা অনুভব করে তাদেরও সম অধিকার আছে এই পাড়ার আলো বাতাসে।বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলাতেও এরকম দৃশ্যের কথা শুনেছি। তাহলে কেনো এখন এই বিক্ষিপ্ত দূর্ঘটনা। তাহলে কি আমরা পিছনে হাঁটছি?
আমার পূজা জানতে শেখা এবং বুঝতে শেখা পাড়ার এই ঘোষ বাড়ির পূজো দিয়ে।সকাল হলেই ঢাকের শব্দ আমাদের জানান দিতে পূজো শুরুর। অপেক্ষা করতাম কখন দশটা বাজবে আর পড়া শেষ করেই দৌড়ে যাব দেখতে। আমরা বাড়ির ভাই বোনেরা সবাই মিলে যেতাম।ঢাকের শব্দের আওয়াজে কান চাপা দিয়েই দাঁড়িয়ে থাকতাম আমরা। ব্যান্ডদলের গানের সুরে শিশু মন নেচে উঠত। তবে সকালের চাইতে বিকেলে যেতে আমরা বেশি পছন্দ করতাম। কারন বিকেলবেলা মিষ্টি খাওয়াতো। কালোজাম, লাড্ডু এসব ছিল লোভনীয় !! ঘোষ বাড়ি থেকেই পরিচয় হয় আমার দেবি দূর্গার সাথে। সেই টানাটানা চোখ, ঝলমলে পোষাক, গয়না ফুলের মালা , তিনটি চোখ, দশটা হাত সবকিছু মিলে এক অসাধারন গল্প ছিল আমাদের কাছে। বিভিন্ন জনের মুখে বিভিন্ন কাহিনী শুনতাম। বোধন আর বিসর্জনের ফারাক বুঝতাম না, কিন্তু শব্দগুলো খুব ভালো লাগত ।সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো বাড়িতে গিয়ে যতই দেবি দূর্গার রূপের বর্ননা করতাম বড়রা একটু বাঁকা চোখে দেখতেন, সেটা বুঝতাম না পরে জানলাম ধর্মীয় নিষেধ।
ঘোষ বাড়ি নিয়ে এমনিতেই আমাদের কৌতুহল ছিল। আমাদের বয়সী কেউ ঐ বাড়িতে ছিল না বলে কারো সাথে বন্ধুত্ব হয়নি তাই যাওয়া হতো না। আমাদের বড়বোনদের সহপাঠিনীরা থাকতেন সেখানে, সুতরাং পূজো হলো একমাত্র সময় ওদের বাড়িতে ঢোকার । ভালো লাগতো যখন দেখতাম লাল পেড়ে সাদা জমিনের শাড়ি পরে আলতা পায়ে মেয়েরা দেবীর জন্য মালা গাঁথছে । গৃহকর্ত্রীরা ব্যস্ত সমস্ত হয়ে পূজোর যোগাড় যন্ত্র করছেন। ডেকোরেটার্সের চেয়ারে বসে পুরোহিতের মন্ত্র শুনতাম। অদ্ভুত এক অনুভূতি!
কেউ বা টুকরি ভর্তি করে ফুল নিয়ে আসছে। ঢাকের শব্দে তখন মন দোলে উঠত। তবে মজার ব্যাপার হলো পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের সময় তারা কখনোই ঢাক বাজাত না, এমনকি আমাদের পাড়ার কেউ কখনোই ওরা পূজা করছে বলে বাঁধা দিত না। আমরা যে যেতাম সবাই দলবেঁধে, অথবা ভাগে ভাগে ওরা কখনোই নিষেধ করেনি। এই যে একটা পারস্পরিক সম্মান বোধ বা শ্রদ্ধা তাতে করে কি কোনো ধর্ম ছোট হয়েছে? এই জন্য কি বলা হয় – যায় দিন ভালো!

যখন কলেজ উঠলাম বাড়ির বাইরে বেরুনো শুরু হলো তখন পূজো দেখার ব্যাপ্তি বাড়ল। নিজের পাড়ার গন্ডি ছেড়ে অন্য পাড়ায় ঘোরাঘুরি শুরু হলো । জুটে গেল বন্ধু বান্ধব। পাড়ার ভাই বন্ধুদের ফেলে কলেজের বন্ধুবান্ধবদের সাথেই পূজার আনন্দ ভাগের সময় এল। দেবি দূর্গার সাথে সাথে নতুন করে চিনলাম স্বরস্বতি , লক্ষী , গনেশ , কার্তিক কে। সেই সাথে মহিশাসুর আর তার বাহন পেঁচা। জানলাম দেবির রুদ্র মূর্তির কাহিনী। বছর বছর সন্তানসহ বাবার বাড়িতে আগমনের কথা, দেখলাম আরতি নৃত্যের বিভিন্ন ভঙ্গিমা। ইতোমধ্যে আমি যোগ দিয়েছে নাটক অঙ্গনে, সেই সুবাদে বেড়ে গেল বন্ধুদের সংখ্যা এবং ঘোরাঘুরি। এই মন্দির সেই মন্দিরের পূজা পেন্ডেল, মন্ডপ দেখা আর দেবির রূপের বিচিত্রতা অবলোকন করা। এই রূপের মুগ্ধতা তো আমাকে আমার ধর্ম থেকে বিচ্যুত করেনি বরঞ্চ একজন শিল্পীর প্রতি আমাকে আকৃষ্ট করেছে। যে মানুষটা এত যত্ন করে এই শিল্পকর্ম করল তার সৃষ্টির তার মেধার মূল্যায়ন তার শ্রমের মর্যাদা তাহলে দেবে কে?
একবার পূজোর একটা ঘটনা আমার সারাজীবন মনে থাকবে। পূজো মন্ডপে গান বাজনা বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হওয়ার একটা রেওয়াজ আছে। আমি যে সংগঠনে যোগ দিয়েছিলাম তারা প্রতি বছর পূজোতে গীতি নাট্য করত। সেবারের গীতিনাটকের নাম ছিল সম্ভবত মহিষাসুর বধ। যেহেতু সংগঠনে আছি আমিও যোগ দিলাম তবে গানের দলে। প্রতিদিন মহড়া করতাম গানের। দু একটা গান এখনো মনে আছে। অষ্টমীর দিন ছিল প্রদর্শনী। প্রদর্শনীর আগে সবার পোষাক পরার বা চূড়ান্ত মহড়ার জন্য আমরা জড়ো হলাম আমাদের পাশের পাড়ার আমার বাল্যসাথীর মন্দিরে ওদের বাসার পাশে। একে তো জীবনে প্রথম বার গান গাইব তার উপর ধুতি পরব সেই উত্তেজনায় আমি অস্থির। হঠাৎ দেখি আমার বড় ভাই আমার খোঁজে মন্দিরে। আমাদের পাড়ার কেউ একজন হয়তো দেখে গিয়ে জানিয়েছে। আমি আগেই বলেছি আমাদের খুব রক্ষনশীল পরিবার যেখানে গান বাজনা করা পুরোপুরি নিষেধ। মন্দিরের সবাই ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরে আমাকে লুকিয়ে রাখল বন্ধুটির বাসায়। তারপর ওখান থেকে আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো পূজা মন্ডপে। যাইহোক অনুষ্ঠান শুরু হলো, গান টান গেয়ে যখন মঞ্চ থেকে নামলাম আমার চক্ষু চড়ক গাছ। আমার বড় ভাই আমার সামনে। কোনো কথা নেই , আমার কান ধরে হেঁটে হেঁটে মন্দির থেকে বাসা। তারপর বাসায় এনে উত্তম মধ্যম তবে সেটা পূজোয় যাওয়ার জন্য না গান গাওয়ার জন্য।
আস্তে আস্তে ঈদের মত পূজো হয়ে গেল আরেকটা বার্ষিক উৎসব। নতুন কাপড় কেনা থেকে শুরু করে নিরামিষ ভোজ, প্রসাদ, মিষ্টান্ন খাওয়া সবই চলল সমান তালে। মাটিতে বসে সবার সাথে কলাপাতায় আহার!খাতির হয়ে গেল রামকৃষ্ণ মিশনের মহারাজদের সাথে। একসময় তো উনারা রীতিমত খবর পাঠাতেন। এই যে সম্প্রীতি আর সৌহার্দ্য এখানে ধর্মটা কখনোই বাঁধা হতে আসেনি অথবা আমি নিজেও অমুসলিম হয়ে যাইনি।
এই বিলেতে এসেও একই ভাবে পালন করেছি এই উৎসব। এবং সব ধর্মের লোককেই দেখি খুব উৎফুল্ল চিত্তে অংশ নিচ্ছে। যদিও এখানে সময়টা খুবই সীমিত। অনেক সীমাবদ্ধতা নিয়ে উৎসব করতে হয়।
তবে কলকাতাবাসীরা একটু এগিয়ে, তারা লগ্নের চেয়েও প্রাধান্য দেয় সপ্তাহান্তের ছুটিকে। পূজোর সামাজিকতা আর রীতি রেওয়াজ তারা সপ্তাহান্তে সেরে ফেলে। বোধন বিসর্জনের বালাই নেই।
ঈদসংখ্যার মত পূজোসংখ্যা বেরুতো কিনা আমার মনে নেই তবে প্রতিটা হিন্দু ঘরে যে দেশ সানন্দার পূজো সংখ্যা থাকতো না সেটা অবিশ্বাস্য। সাহিত্যানুরাগী মুসলিমরাও সংগ্রহে রাখতেন। যারা পেতেন না তারা ধার করে পড়ে চালিয়ে নিতেন। পূজো সংখ্যা মানেই তো শীর্ষেন্দু সুনীল সমরেশ এর মত দিগ্গজদের লেখালেখি। এটা কি কোনোভাব বাদ দেয়া যায়। দেশ ম্যাগাজিন তো সাজিয়ে রাখার মত ছিল, অনেকটা সেই ঘরের বাসিন্দারা অনেক সমাঝদারের পরিচয় দেয়ার মত। এইচ এম ভি’র ক্যাসেট বেরুতে পূজো উপলক্ষে। হেমন্ত মান্না কিশোর কুমার। কলকাতার পূজোর ঢেউ বাংলাদেশেও লাগত; সংস্কৃতির কি আর দেশ সীমারেখা থাকে!!
পূজোতে যে প্রেমপর্ব চলে না সেটার দিব্যি দেওয়া যায় না। বরঞ্চ মোক্ষম সময়। কে কার খোঁজ তখন রাখে। এটাই তো সুযোগ একটু ঘুরে বেড়ানোর, একটু পাশে বসার, একটু দূরে গিয়ে সময় কাটানোর। মন্ডপ দেখার উসিলায় । যাক ঐ পর্বের আলোচনায় না যাওয়াটা ভালো।

দেখতে দেখতে বিসর্জন। ট্রাকের পর ট্রাকের সারি। সকল দেবি একসাখে দর্শনের সুযোগ। সন্ধ্যায় শুরু হয়ে রাতে নদীর জলে ভাসিয়ে সমাপন হতো উৎসবের । তার আগে সিঁদুরের আবিরের খেলা। নিজেদের উৎসবের রঙে রাঙিয়ে নেয়া। হয়তো এই আবির সিঁদুর খেলার পেছনে ধর্মীয় কোনো ব্যাখ্যা রয়েছে।এবং আবার আগমনের প্রতীক্ষা।
উৎসবকে উৎসব পর্যন্ত রাখাটা সমাজের সকলের জন্য জরুরী। ধর্ম যার যার উৎসব সবার এই কথাটাও কোনো রকম দ্বিধা ছাড়া বিশ্বাস করা উচিত। একজন মানুষ হিসেবে আমাদের দায়িত্ব আমার কোনোকাজে যেন সমাজ বা অন্য কারো ক্ষতি না হয়। আমার নিজের আচরনে যেন কোনো ভূল ব্যাখ্যার প্রতিফলন না হয় আমার নিজ পরিবার তথা ধর্মের উপর। প্রতিটি ধর্মের মধ্যেই রয়েছে ধর্ম বিদ্বেষী মানুষ, সে নিজ ধর্ম হোক অথবা অন্য ধর্মের প্রতি হোক। আমি যদি কোনো ধর্ম মানি না তাহলে আমারও উচিত হবে না অন্য ধর্মের উৎসব নিয়ে মাতামাতি করার। তাতে বিভেদটা বেশি বাড়ে বলেই মনে হয়। সবারই পূর্ন অধিকার আছে পছন্দের ধর্ম পালন করার।তবে সেটা অন্যজনের অন্যধর্মের প্রতি সম্মান শ্রদ্ধা রেখে। খুব সহজে কারো ধর্ম নষ্ট হয় না , আবার অন্য ধর্মের শ্রদ্ধা দেখালেও কোনো ধর্ম কলুষিত হয় না। মানুষ না আসলে ধর্ম কি এই পৃথিবীতে আসত?
আমার সকল বন্ধুদের প্রতি রইল শারদীয় শুভেচ্ছা ।
যাদের সাথে আমি এই উৎসব গুলো পালন করে আমার দিনগুলোকে স্মৃতিময় করেছি তাদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা।
জ্যোতিধারা সম মঙ্গলগীতি ঘোষিবে বিশ্বময়।