প্রচ্ছদ প্রবন্ধ মা তোমার ভাবনারই প্রতিফলন আমি

মা তোমার ভাবনারই প্রতিফলন আমি

0
রোকেয়া কবীর  : আমরা যে এখন ইক্যুয়াল সিটিজেনশিপ বা সমনাগরিকত্ব নিয়ে কাজ করি, কথা বলি; আমার মায়ের সময় এসবের কোনো বালাই ছিল না। আমার মা বাড়িতে মাদ্রাসায় পড়েছেন। তার কোনো উচ্চশিক্ষা ছিল না। কিন্তু পুরোমাত্রায় তার এই বোধ ছিল যে, ধনী-গরিব সব মানুষকে, সব ধর্মাবলম্বীকে শ্রদ্ধা করতে ও সমান দৃষ্টিতে দেখতে হয়।
আমার স্পষ্ট মনে আছে, ১৯৬৪ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় আমাদের বাড়িতে প্রচুর দরিদ্র হিন্দু পরিবার আশ্রয় নিয়েছিল। এক সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি আমাদের বাড়ির ভেতরের ও বাইরের উঠান ভরা জেলেপাড়ার নারী-পুরুষ-শিশু। তাদের থাকতে দেয়া হয়েছে আমাদের বাড়ির দুটো পাটের গুদামে। বাবা বাড়ির কামলাদের নির্দেশ দিচ্ছেন ওদের জন্য আলাদা রান্নাঘর তৈরি করে দেয়ার জন্য।

কিছু না বুঝে আমি মাকে জিজ্ঞেস করলাম, আমাদের এত বড় রান্নাঘর থাকতে আবার কেন রান্নাঘর তৈরি করতে হচ্ছে? মা বললেন, ‘ওরা হিন্দু ধর্মের মানুষ। আমরা আমাদের চুলায় গরুর মাংস রান্না করি বলে ওরা আমাদের হাঁড়ি-পাতিল বা রান্নাঘর ব্যবহার করতে পারে না। তাতে ওদের ধর্ম নষ্ট হবে।’ ছোটমানুষ আমি ছোটর মতোই বিস্ময় নিয়ে বললাম, জান বাঁচে না আর একই রান্নাঘর ব্যবহার করলে ধর্ম চলে যায়! মা বললেন, ‘না মা, এভাবে বলতে হয় না। ওরা বিপদে পড়ে আমাদের এখানে আশ্রয় নিয়েছে। ওদের ধর্ম নষ্ট করা মানুষের কাজ হবে না।

আমার মা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন। তিনি নারী অধিকার, মানবাধিকার নিয়ে কোথাও থেকে কোনো শিক্ষা পাননি। কিন্তু অন্যের অধিকার খর্ব করার পক্ষে কখনও সায় দিতেন না। তার মধ্যে মানবিকতা, অন্যের দুঃখ-কষ্টে তাদের প্রতি সহমর্মী আচরণ ও সহৃদয়তা প্রদর্শনেও কোনো কমতি ছিল না।

মায়ের কাছে শোনা কিছু গল্পের কথা মনে পড়ে, যেগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, দেশ-বিদেশের নানা ওয়ার্কশপ-সেমিনারে যোগ দিয়ে অর্জিত হয়নি। ওগুলো ছিল তার যাপিত জীবন থেকে শেখা, অথচ সে সবের মর্মকথা উচ্চশিক্ষিত মানুষকেও স্পর্শ করে।

নারীদের পর্দা করা নিয়ে মা একটি গল্প শুনাতেন। গ্রামের মেয়েরা দলবেঁধে একটা পুকুরে গোসল করত। পুকুরের পাশ দিয়ে ছিল বাজারে যাওয়ার রাস্তা। কেউ যাতে বেপর্দা অবস্থায় তাদের দেখে না ফেলে সে জন্য পুকুরের কোনায় ছোট একটা ছেলেকে দাঁড় করিয়ে রাখা হতো। ছেলেকে বলে দেয়া হয়, কোনো মানুষকে এদিকে আসতে দেখলে সে যেন তাদের ডাক দেয়, যাতে তারা ঝোপের আড়ালে গিয়ে লুকাতে পারে। কিছুক্ষণ পর ছেলেটা হাঁক দেয়, একজন মানুষ এদিকে আসছে। মেয়েরা পানি থেকে হুড়মুড় করে উঠে ঝোপের আড়ালে লুকায়। সেখান থেকে দেখলেন, ঘোড়ার পিঠে পাট নিয়ে এক লোক বাজারে যাচ্ছে। মেয়েরা বাইরে এসে ছেলেটিকে তিরস্কার করে বলল, ‘তুই যে বললি মানুষ আসতেছে, কিন্তু মানুষ কই? ও তো ঘোড়াওয়ালা।’

পর্দা করতে হয় কেবল ধনী, শিক্ষিত ও অভিজাতদের সামনে; গরিব শ্রেণীর লোক ‘মানুষ’ নয়, তাদের সামনে কোনো পর্দার দরকার নেই। পর্দাসংস্কৃতির গ্রামীণ এই প্রথাকে সম্ভবত একটু ব্যঙ্গ করেই মা এই গল্পটি আমাদের শুনাতেন। আমার মায়ের ভাণ্ডারে এরকম অনেক গল্প ছিল।

আমাদের নয় ভাই-বোনের সংসারকে মা বিচক্ষণতার সঙ্গে আগলে রেখেছিলেন। ধান-পাট-রবিশস্যের মাড়াই মৌসুমে বাড়িতে কাজ করতেন অনেক নারী-পুরুষ কামলা। সবার অন্ন জোগাতে মাকে রান্নাঘর সামলাতে হতো। মায়ের রান্নাঘরের চার দেয়ালে বন্দি জীবন দেখে অনেক কষ্ট অনুভব করতাম। আমার কাছে তার এ জীবনকে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। এ কারণেই বোধ হয় নারীদের রান্নাঘরের জোঁয়ালের নিচ থেকে বের করে এনে আরও বড় জগতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়ার চেষ্টাই হয়ে ওঠে আমার পরবর্তী জীবনের ব্রত।

মা মাদ্রাসায় পড়লেও তিনি আমাদের নয় ভাই-বোনকে মাদ্রাসায় যেতে দেননি। এ নিয়ে গ্রামের লোক ও আমার মাতুলালয়ের লোকজনও টিপ্পনি কাটতে ছাড়ত না। তারা মাকে বলত, ‘সব ছেলেমেয়েকেই তো ইউনিভার্সিটিতে পড়াচ্ছ, তোমার বেহেশতে যাওয়ার রাস্তা বন্ধ!’ মা তাদের সঙ্গে তর্কে জড়াতেন না। বরং শান্তভাবে বলতেন, ‘দিনকাল বদলে গেছে। জমিজমার ওপর নির্ভর করে ওরা বাঁচতে পারবে না। ওদের স্বনির্ভর হওয়ার পথ ওদেরই তৈরি করে নিতে হবে।’ মায়ের এই বাস্তবভিত্তিক মূল্যায়নে সুদূরপ্রসারী ভাবনারই পরিচয় মেলে।

আমার গায়ের রঙ অন্য ভাই-বোনদের তুলনায় কালো বলে পাড়া-প্রতিবেশী এবং অনেক আত্মীয়স্বজন মন্তব্য করেছেন¡ ‘কীভাবে এই মেয়েকে বিয়ে দেবে?’ এ ব্যাপারে মায়ের সহজ উত্তর ছিল¡ ‘ওর পড়াশোনার মাথা আছে। ওকে নিয়ে কোনো চিন্তা করতে হবে না। নিজের পথ ও নিজেই দেখবে।’ আমার সম্পর্কে মায়ের এই উচ্চ ধারণা আমাকে পড়াশোনায় আরও আগ্রহী করে তুলত। এই ছিলেন আমার/আমাদের মা সৈয়দা বদরুন্নেসা। তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন ১৯৯১ সালে। তার স্মৃতির প্রতি রইল অশেষ শ্রদ্ধা।

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here