প্রচ্ছদ ফিচার তারামন বিবি: সীমাহীন সাহসের নাম

তারামন বিবি: সীমাহীন সাহসের নাম

0
জায়েদ হাসান : ১৯৭১ সাল। ১৬ ডিসেম্বর। পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয় বাংলাদেশ। বিশ্বের বুকে রচিত হয় এক নতুন ইতিহাস। নতুন এক মানচিত্র। আর এই জয় ছিনিয়ে আনতে জীবন বাজি রেখেছিলে বেশ কয়েকজন নারী। তাদের মধ্যে একজন হলেন তারামন বেগম। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি তারামন বিবি নামে পরিচিত ছিলেন।

অসীম সাহসিকতার এক প্রতীক এই বীর নারী। মুক্তিযুদ্ধের সময় নিজ গ্রাম কুড়িগ্রাম জেলার শংকর মাধবপুরে ছিলেন। তখন ১১ নং সেক্টরের নেতৃত্বে ছিলেন সেক্টর কমান্ডার আবু তাহের। মুহিব হাবিলদার নামে এক মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবিকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য উৎসাহিত করেন। তখন ১৪ বছর বয়সী এক কিশোরী ছিলেন তিনি।
তারামন বিবির ভাষ্য, তখন সন্ধ্যা। রান্নার জন্য কচুরমুখি তুলছিলেন। এ সময় পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন এক মুক্তিযোদ্ধা। তার নাম মুহিব হাবিলদার। তিনি তাকে তার সঙ্গে ক্যাম্পে নিয়ে যেতে চাইলেন। রান্নার কাজের জন্য। বিষয়টি মাকে জানালেন তারামন। কিন্তু মা দেশের কথা ভেবে ক্যাম্পে যেতে অনুমতি দিলেন।
মুহিব হাবিলদার তারামন বিবিকে তার ধর্মমেয়ে বানালেন। ক্যাম্পে মূলত রান্নার কাজই করতেন তিনি। আর মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রগুলো মুছে পরিষ্কার করতেন। রান্নার ফাঁকে মুহিব হাবিলদার তাকে অস্ত্র চালানো শেখাতেন।
প্রথমে তারামন বিবিকে রাইফেল চালানো শেখানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু ছোট হওয়ায় বুকে ব্যথা পেতেন তিনি।পরে স্টেনগান চালানো শেখেন। পরবর্তীতে সহকর্মীদের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেন। পাকিস্তানি বাহিনীর খবর সংগ্রহ করতেন।
ক্যাম্পে তিনিই ছিলেন সবার ছোট। তাই সবাই তাকে আদর করতেন। ​১৯৭১ সালে একদিন দুপুরে খাওয়ার সময় পাকিস্তানি বাহিনী একটি গানবোট নিয়ে তারামন বিবির ক্যাম্পের দিকে আসতে থাকে। খবর পেয়ে তিনি তার সহযোদ্ধাদের সঙ্গে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। শত্রুকে পরাস্ত করেন। পরবর্তী সময়ে বেশ কয়েকটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন তিনি। বেশ কয়েকবার মৃত্যুর মুখে পড়েন। কিন্তু সাহসিকতা ও ভাগ্যের জোরে বেঁচে যান।
যুদ্ধ শেষে মায়ের কাছে ফিরে আসেন তারামন। এরপর ১৯৭৩ সালে তৎকালিন সরকার ‘বীর প্রতীক’ উপাধিতে ভূষিত করে তাকে। তারপর ১৯৭৪ সালে আবদুল মজিদের সঙ্গে বিয়ে হয় তার। এই নারীর এক ছেলে আবু তাহের, ও মাজেদা খাতুন নামে এক মেয়ে আছে।
একসময় তারামন বিবিকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। স্বাধীনতা অর্জনের ২৪ বছর পরও তার সন্ধান মেলেনি। দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর ১৯৯৫ সালের দিকে তার সন্ধান মেলে। ময়মনসিংহের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক বিমল কান্তি তাকে খুঁজে বের করেন। নারী সংগঠনগুলো তাকে ঢাকায় নিয়ে আসে। ওই বছর ১৯ ডিসেম্বর তৎকালীন সরকারের পক্ষ থেকে তারামন বিবির হাতে বীরত্বের সম্মাননা তুলে দেওয়া হয়।
১৯৫৭ সালে রাজীবপুর উপজেলার কোদালকাটি ইউনিয়নের শংকর মাধবপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তারামন বিবি। তার বাবার নাম আবদুস সোহবান ও মায়ের নাম কুলসুম বিবি।
দীর্ঘদিন ধরে ফুসফুসের সংক্রমণ, শ্বাসকষ্ট আর ডায়েবেটিসে ভুগছিলেন তারামন। বিজয়ের মাসের প্রথম প্রহরে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন রণাঙ্গনের এই মুক্তিযোদ্ধা। কুড়িগ্রামের রাজিবপুর উপজেলার শংকর মাধবপুর গ্রামে নিজের বাড়িতে লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যান তিনি। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬২ বছর। শনিবার (১ ডিসেম্বর ২০১৮) দুপুরে রাজিবপুর উপজেলার কাচারীপাড়া তালতলা কবরস্থানে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাকে দাফন করা হয়।