প্রচ্ছদ প্রবন্ধ এরশাদ সাহেবের কথা খুব মনে পড়ছে

এরশাদ সাহেবের কথা খুব মনে পড়ছে

0
ছবি: সংগৃহীত
গোলাম কিবরিয়া: গত দুই তিন দিন থেকে এরশাদ সাহেবের কথা খুব মনে পড়ছে। তাকে নিয়ে ছোট্ট একটা স্মৃতি মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। সিএমএইচ এর আইসিইউতে জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে এরশাদ-  বিভিন্ন মিডিয়ায়  এমন খবর দেখে কিছুটা খারাপও লাগছে।

আমার স্কুল জীবন শুরু হয়েছে এরশাদ সাহেবের শাসনামলে। ছোটবেলায় বিটিভির খবর নিয়মিত দেখতাম। সংবাদ দেখে মনে হতো এরশাদের নেতৃত্বে উন্নয়নের জোয়ারে দেশ ভাসছে। তাছাড়া  একজন রাষ্ট্রপতি যখন বন্যা দুর্গত মানুষের সাহায্যার্থে বুক সমান পানি ভেঙে এগিয়ে যান, তার প্রতি শ্রদ্ধা তখন এমনিতেই আসে।

কিন্তু স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন দেখে ও পরবর্তীতে তার সম্পর্কে বিভিন্ন কেচ্ছাকাহিনী শোনে তার প্রতি আমার অকুণ্ঠ সমর্থনে কিছু দিনের জন্য ভাটা পড়ে । তবে গত প্রায় দুই দশকে খালেদা-হাসিনার শাসন দেখে এবং বিশেষত বর্তমান পরিস্থিতিতে মনে হয়, এরশাদের শাসনামলই সম্ভবত ভালো ছিলো।

তাছাড়া এরশাদ সাহেবকে খুব কাছে থেকে দেখার ও তার সাথে সংক্ষিপ্ত কথা বলতে পারার আমার হঠাৎ হওয়া একটি  সুযোগলব্ধ অভিজ্ঞতা আমাকে তার একজন ভক্ত অনুরক্ত বানিয়ে রেখেছে।

ছিয়ানব্বই এর ডিসেম্বর মাস। আমি তখন কিছু দিনের জন্য ঢাকায় অবস্থান করছি। তারিখটা সম্ভবত দশই ডিসেম্বর। সকালে পত্রিকা পড়ে জানলাম, এরশাদ সাহেব জেল থেকে ছাড়া পেয়েছেন। উঠেছেন গুলশানের বাসায়। পেপার রেখে বিলম্ব না করে কৌতূহলী আমি একটি বেবিট্যাক্সি নিয়ে ছুটলাম গুলশানের দিকে। উদ্দেশ্য এরশাদ সাহেবের বাড়ির আশপাশের পরিস্থিতি নিজ চোখে দেখবো। ড্রাইভারকে আমার মনোবাসনা জানাতে বেচারা খোঁজাখুঁজি করে আধাঘন্টার মধ্যেই এরশাদ সাহেবের বাড়ির নিকটে আমাকে নামিয়ে দিলো। চৌষট্টি নম্বর সড়কের আট নম্বর বাসা। দেয়াল ঘেরা বাসার সামনে পুলিশের একটি ট্রাক দাড়ানো। ট্রাকটি পূলিশে পূর্ণ। তাই কাছে যাওয়ার সাহস হলো না। একটু দৃরে থেকেই কিছুক্ষণ দেখলাম। কাছাকাছি আরো কিছু উৎসুক মানুষের জটলাও লক্ষ্য করলাম। তবে এরশাদ সাহেবের বাড়িতে কাউকে ঢুকতে বা বেরুতে দেখলাম না। রাস্তায় কিছুক্ষণ পায়চারীর পর যখন ফিরে আসার চিন্তা করছি, তখন দেখলাম একটি  সাদা মিনিবাস বাড়়ীর গেটের কাছে এসে থাামলো। গাড়ি থেকে একে একে আট নয়় জন তরুণ ও মধ্য বয়সী মানুষ নামলেন। আমি আগ্রহী হয়ে তাদের একটূ কাছে ভিড়লাম। অনুমান করলাম তারা এরশাদ সাহেবের বাড়িতে যাবেন। তাদের কথা বার্তা শোনে বুঝলাম আমার অনুমান ঠিক। তারা এরশাদ সাহেবের বাড়িতে তখনই ঢুকবেন?- নাকি একটু পরে যাবেন?-সেই সম্পর্কে পরামর্শ করছিলেন। আমি সালাম দিয়ে তাদের দলনেতা গোছের একজনের দিকে এগোলাম। মাঝারী উচ্চতার স্বাস্থ্যবান মানুষ। তাকে বললাম, আমি সিলেট থেকে এসেছি। এরশাদ সাহেবের সাথে দেখা করতে চাই। দলনেতা অবাক হয়ে তাকালেন।  জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কি স্যারের সাথে আজ সিলেটে যাচ্ছেন?” শোনে কিছুটা চমকে গেলাম, তবে সামলে নিয়ে বললাম, “জ্বী না। ঢাকায় কিছু জরুরী কাজ থাকায় যেতে পরছি না। তাই সম্ভব হলে দেখা করতে চাই।”  উনি কি ভাবলেন- জানি না। তবে দু একজন সহযাত্রীর সাথে মুখ চাওয়া-চাওয়ির পর বললেন, “চলুন তাহলে আমাদের সাথে”। আমার মনের আনন্দ তখন দেখে কে ? এ যেনো মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। এসেছিলাম সাবেক রাষ্ট্রপতির বাড়ি দেখতে, এখন স্বয়ং বাড়ির মালিকের সাথে সাক্ষাতের সুযোগ- কী সৌভাগ্য!

যাইহোক, জাতীয় পার্টির ঐ নেতা কর্মীদের সাথে খুব সহজে সিকিউরিটি পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম এরশাদ সাহেবের ড্রইংরুমের দরজায়। বেল টিপতেই একজন স্টাফ এসে আমাদের স্বাগত জানিয়ে ভিতরে নিয়ে গেলেন। মনে হলো দলটির আগমনের কথা আগেই জানতেন। তিনি আমাদের বসতে বললেন এবং জানালেন, স্যার কিছুক্ষণের মধ্যেই আপনাদের সাথে দেখা করবেন। এরশাদ সাহেবের ড্রইংরুমটা বেশ বড়ো । একসাথে পনেরো বিশজন মেহমান অনায়াসে বসার মতো সোফা পাতানো আছে রুমের তিন দেয়াল ঘেঁষে। সোফায় বসে পিন পতন নীরবতায় সবাই নেতা দর্শনের অপেক্ষায় রইলাম। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই এরশাদ সাহেব পর্দা ঠেলে ভিতরে ঢুকলেন। সবাই দাড়িয়ে গিয়ে প্রায় একসাথেই সালাম দিলাম। এরপর এক আজব কান্ড ঘটলো। দর্শনার্থীদের প্রায় সবাই হুমড়ি খেয়ে এরশাদের পায়ে পড়লেন। কার আগে কে কদমবুসি করবেন, তার প্রতিযোগিতা চললো। ঘটনার আকস্মিকতায় একটু দ্বিধান্বিত হয়ে আমি দাঁড়িয়ে থাকলাম। কারণ একমাত্র বাবা মা ছাড়া অন্য কাউকে কদমবুসি করার অভ্যাস ছিলো না। বিষয়টি বোধহয় এরশাদ সাহেবের চোখ এড়ালো না। উনি সবাইকে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে হাত ধরে উঠালেন। আমার দিকে ইশারা করে প্রতিনিধি দলের নেতাকে জিজ্ঞেস করলেন, ও কে? আমাদের দলনেতা বললেন, “স্যার, উনি সিলেট থেকে এসেছেন আপনার সাথে দেখা করতে। ছাত্র সমাজ করেন।” আমার অজানা পরিচয় জেনে পুলকিত হলাম, তবে প্রতিবাদ করে ভদ্রলোককে বিব্রত করতে চাইলাম না।

আমি শুধুমাত্র তাকে দেখার জন্য সিলেট থেকে গিয়েছি জেনে এরশাদ সাহেব খুশী হলেন মনে হলো। আমার দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন, “আমি তো আজই সিলেটে যাচ্ছি। মাজার জেয়ারত করবো”। বললাম, “জ্বী স্যার, আমার ভাগ্য ভালো যে আপনার সাথে সরাসরি দেখা হলো।” আমার কথা শোনে তিনি হাসলেন। তবে কিছু বললেন না। এরপর সবাইকে বসতে বললেন। আমাদের দলনেতা ‘স্যার’ এর শরীর স্বাস্থ্যেের খোঁজ খবর নিলেেন। এরশাদ সাহেব সবাইকে ‘আপনি’র বদলে ‘তুমি’ বলেই সম্বোধন করলেন। বিভিন্ন বিষয়ে টুকটাক কথা বললেন। পার্টির সবার কাছে সালাম পৌঁছে দিতে বললেন। আরো বললেন, “জনগণ আমাদের সাথে আছে। তাই শত প্রতিকূলতার মাঝেও পার্টির জন্য কাজ করে যেতে হবে।

কিছুক্ষণ পর একজন কাজের বুয়া ট্রলি-ট্রেতে করে সবার জন্য চা, সাথে সাধারণ মানের গোলাকৃতি টাইপের কিছু বিস্কুট এনে মাঝখানের টেবিলে রাখলেন। এরশাদ সাহেব বললেন “আমি জেলে ছিলাম বলে বাড়িতে আপ্যায়নের তেমন বন্দোবস্ত নাই। তাছাড়া রওশন ও এখন বাইরে। তাই আপনাদের ভালো মতো আপ্যায়ন করতে পারছি না বলে দুঃখিত। ” এই বলে একসময়ের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদ নিজের আসন থেকে উঠে আমাদের মতো নগণ্য অতিথিদের হাতে হাতে চায়ের কাপ তুলে তুলে দিলেন। তার এই অমায়িক ব্যবহারে সকল অতিথিই মন্ত্রমুগ্ধ ও বিস্মিত মনে হলো।
এরশাদ সাহেবের সেদিনের বিনয় আমাকে এতো অভিভূত করেছিলো যে, আমি সিলেটে ফিরে তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে একটি চিঠি পাঠিয়েছিলাম। কোনো প্রত্যুত্তর আশা করিনি। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে মাস খানেকের মধ্যে এরশাদ সাহেবের নিজ হাতে সই করা ফিরতি চিঠি পেলাম।
আফসোস, এদেশে আসার সময় চিঠিটা দেশে রেখে এসেছিলাম। কিন্তু ফেরত গিয়ে আর খোঁজে পাইনি।
এরশাদ সাহেব সম্পর্কে আরো কিছু তথ্য জেনেছি বেলজিয়ামে গিয়ে। প্রায় এক যুগ আগের কথা। বেলজিয়ামের Namour city তে সফরকালে সেখানকার স্বনামধন্য এক প্রবাসী বাংলাদেশী ‘অল ইউরোপীয়ান জাতীয় পার্টির কোঅর্ডিনেটর (ভদ্রলোকের নামটি ভূলে গেছি) তার বাসায় চায়ের দাওয়াত করলেন। মাঝারি গড়নের অত্যন্ত হাসিখুশি ও অতিথি পরায়ন মানুষ। দেশের বাড়ি হবিগঞ্জ। তিনি তার সুন্দর ও বড়োসড়ো বাড়ির প্রায় সকল অংশই ঘুরে ঘুরে দেখালেন। তবে একটি তালাবন্ধ কক্ষের সামনে এসে বললেন, “এই রুমটি একটি সংরক্ষিত কক্ষ। ইউরোপ সফরে আসলে স্যার (অর্থাৎ এরশাদ সাহেব)  এই রুমে থাকেন। তাই এই রুমটি আমরা সব সময় বন্ধ রাখি। শুধু স্যার আসলে খুলে দেই।” কোঅর্ডিনেটর সাহেব আরো জানালেন, এরশাদ সাহেবের নাকি কমপক্ষে প্রায় দুই হাজার দত্তক ছেলেমেয়ে আছে যাদের লেখাপড়া, এমনকি ভরন পোষণের খরচও এরশাদ সাহেব নিজে বহন করেন !
সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদ সম্পর্কে অনেকের অনেক অভিমত থাকতে পারে। কারণ দোষে গুণেই মানুষ।  তাই জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা এই সাবেক রাষ্ট্র নায়কের মাগফিরাত ও নাজাতের জন্য দোয়া করছি। আল্লাহ্ তার দোষ ত্রুটি গুলো ক্ষমা করুন এবং ভালো কাজের উত্তম প্রতিদান দিন। তার হায়াত থাকলে সুস্থ করে দিন। আর জীবন ফুরিয়ে এলে তাকে ইমান ও আরামের সাথে জান্নাতের মেহমান করে নিন। আমীন।