প্রচ্ছদ ফিচার করোনা যুদ্ধে জয়ী হওয়া এক নারীর গল্প।

করোনা যুদ্ধে জয়ী হওয়া এক নারীর গল্প।

0
মো: রেজাউল করিম মৃধা: একজন সাংবাদকর্মী হিসেবে প্রতিদিনই ছুটে বেড়াতে হয় সংবাদের পিছনে।কখনো আগুনে পুড়ে যাওয়া, কখনো মার্ডার, মায়ের সামনে ছেলের নিসংশ হত্যা, বন্ধুরা ডেকে নিয়ে খুন, আবার পরীক্ষায় ভালো ফলাফল কিম্বা রানী কর্তীক খেতাব অর্জন সহ  বৃটেনের, বাংলাদেশীদের সাফল্য , বাংলাদেশ রাজনৈতিক সর্বাচ্চ আসনের ব্যাক্তিদের স্বাক্ষাতকার গ্রহন।এছাড়া প্রতিদিনের ঘটনাগুলোতো আছেই।
মাঝে মাঝে কিছু ঘটনা মনকে নাড়া দেয়। বুক ফেটে যায়, মনের অজান্তেই চোখ দিয়ে গড়িয়ে পরে অশ্রু। আবার নিজেকে সামলে নিয়ে কাজ করতে হয়। বলার কিছুই থাকেনা। শুধু তাদের ঘটনা গুলি ভিডিও ধারন করে নিউজে প্রচার করতে হয়।কিন্তু সেই দু:ক্ষের বা সুখের স্মৃতি গুলি স্মৃতি হয়ে থাকে।
আজ তেমনি এক ঘটনা আমারে নাড়া দিয়েছে।করোনাভাইরস মহামারিতে একজন নারী করোনাভাইরসে আক্রান্ত হয়েও বেঁচে এসেছেন। অথচ সে নিজেও জানতো না আবার পৃথিবীতে বেঁচে থাকবেন। ফিরে পাবেন স্বামী এবং একমাত্র ছোট্ট ছেলেকে। ডাক্তাররা হতাশ ছিলেন। হতাশ হয়ে বলেছিলেন।”আপনার নিকট আত্বীয় কাউকে খবর দিতে পারেন। তার নিকট বিস্তারিত বলবো”। কেননা স্বামী বেচারা তো ছেলে নিয়ে হোম কুয়ারেন্টে আছেন। স্বামী জানেন হয়তো আমার স্ত্রী আর ফিরে আসবে না। এখানে করো কিছুই করার নেই। সবাই যেন নিরব দর্শক।
বর্তমানে কভিট ১৯ বা করোনাভাইরস মহামারিতে প্রতিদিনই করোনাভাইরসের খবর সংগ্রহ করতে হয়। কখনো হাসপাতালে, হাসপাতালের মর্গে, জানাজায়, কিম্বা সুস্থ্য হওয়া রোগীর বাসায়।করোনাভাইরসে আক্রান্ত হয়ে প্রায় দ্বেডশতাধীক বৃটিশ বাংলাদেশী মারা গেছেন। (ইন্নাহ লিল্লাহ —- — রাজিউন)।আবার অনেকেই সুস্থ্য হয়ে বাড়ী ফিরছেন।
করোনার সাথে যারা যুদ্ধ করে ফিরে এসেছেন। তাদেরই একজন।লন্ডনের পাশে , কেন্ট কাছে উলউইচের বাসিন্দা শিরিন আব্দর স্বামী নাহিদ জামান এবং একমাত্র সারে পাঁচ বছরের ছোট্ট ছেলে। শিরিন আব্দর  বলেন “করোনা হলেই মৃত্যু হবে এমন নয়, সুস্থ্য হয়ে বাড়ী ফিরছেন অনেকেই”।  লন্ডনের শিরিন আবদুর তাদেরই একজন যারা করোনা যুদ্ধে জয়ী হয়ে বাড়ী ফিরেছেন। সেই সাথে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে স্বামী ও সন্তানকেও রেখেছেন নিরাপদ। চারদিকে যখন মৃত্যুর মিছিল, তখন কেমন করে বেঁচে ফিরলেন শিরিন? সেই অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন আমাদের কাছে।
বাংলাদেশের কোন কোন করোনা রোগী সামাজিক ভাবে তাচ্ছিল্যের শিকারও হচ্ছেন। কিন্তু নাহিদ জামান তার সারে পাঁচ বছরের শিশু সন্তান সহ কিভাবে করোনা আক্রান্ত স্ত্রীকে নিয়ে এক ছাদের নিচে ভালো আছেন সেই অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই আমাদের অনুপ্রেরণা যোগাবে।
শিরিন আব্দুর আরো বলেন করোনাভাইরসে আক্রান্ত হয়ে যখন শ্বাস নিতে না পেরে ছটফট করছিলেন।তার মনে হয়ে ছিলো জীবন বুঝি যায় যায়, স্বামী বা করো কিছুই করার ছিলো না তারাতো ঘরে বন্ধি। শুধু মাত্র হাসপাতালে ফোন।ভাগ্য সুপ্রসন্ন তাই হাসপাতাল নিয়ে ডাক্তার এবং নার্সরা সাথে সাথে ভেনিটলিটর দেওয়াতে শ্বাস নেওয়া শুরু করেন। হয়তো আর এক মূহুর্ত দেড়ী হলে ঝড়ে যেতো আরেকটি ইয়াং লেডির প্রাণ।
এই ভাইরাসের পূর্ববর্তী লক্ষণগুলো হলো-
(ক) সর্দি  (খ) গলা ব্যথা। (গ) কাশি (ঘ) মাথা ব্যাথা  ঙ) জ্বর  চ) হাঁচি (ছ) অবসাদ  (জ) শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে কোনো বয়সের মানুষ করো’নায় আ’ক্রান্ত হতে পারে। এমনকি স্বাস্থ্যবানরাও আ’ক্রান্ত হয়ে মা’রা যাচ্ছে। তবে বয়স্ক, শারীরিকভাবে দুর্বলরা বেশি ঝুঁ’কিতে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করোনায় মৃত্যুদের মধ্যে শারীরিকভাবে দুর্বল: যেসব মানুষ আগে থেকেই শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে আছেন; বিশেষ করে যারা ডায়াবেটিস, অ্যাজমা, উচ্চ রক্তচাপ, ফুসফুসে সমস্যা, হ’জমের সমস্যায় ভুগছেন- তাদের মৃত্যু হার বেশি।
সেই কস্ট গুলি এত কস্টদায়ক ও যন্ত্রনময় যার না হয়েছে তাকে কুঝানো যাবেনা যখন বলছিলেন,তখন তার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছিল। সত্যি অসহ্য যন্ত্রনা এ কথা গুলি অন্যান্য করোনা রোগীদের কাছ থেকে শুনেছি। অন্যান্য রোগীরা বাসাতেই আইসোলেশনে ছিলেন। বাসাতেই আলাদা রুমে থেকেছেন। মাঝে মধ্যে নার্স বাসায় এসে দেখে যেতেন আর ডাক্তার ফোনের মাধ্যমে খোঁজ খবর নিতেন।
কিন্তু এ রোগী সম্পূর্ন ভিন্ন। প্রথমে বাসায় ছিলেন অবস্থা যখন বেশী খারাপ তখন তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। কেউ জানেনা আর আর ফিরে আসবে কিনা? কিন্তু আল্লাহ মেহেরবান হাসপাতালের নেওয়ার পর সে ব্যাথায়, শ্বাসকস্টে কাতরাচ্ছিলেন। তখন শুধু মাত্র ভেন্টেলেটর দেওয়া ছাড়া আর কিছুই ছিলো না।ভেন্টেলেটরের মাধ্যমে শ্বাস নিতে নিতে ধীরে ধীরে সে সুস্থ্য হতে থাকে প্রায় ২০ দিন হাসপতালে থাকার পর কিছুটা সুস্থ্য হলে তাকে বাসায় পাঠানো হয়। বাসায় ও প্রায় ২০/২২ দিন যাবৎ আলাদা ঘরে অবস্থান করছেন। তার ছোট্ট ছেলেটিও প্রথম প্রথম শুধু ফোনে কথা বলা তো।  ভাগ্যের কি পরিহাস একই ছাদের নিচে কিন্তু কারো সাথে দেখা নেই। রুমে যাওয়া নিষেধ। এর কয়েক দিন পর থেকে এর পর রুমের দরজা খুলে কয়েক মিনিট দূর থেকেই মার সাথে কথা বলা শুরু করে ছোট্ট ছেলেটি। আর স্বামী বেচারা দরজা খুলে , রুমের সামনে খাবার রেখে চলে যেতেন। খাবার শেষ হলে বা কিছু প্রয়োজন হলে ফোনের মাধ্যমে কথা এ ভাবেই চলছে তাদের জীবন।
বেশীর ভাগ সময় খাবারের অর্ডার দিয়ে আনা হয় । আবার নিকট আত্বীয় ও বন্ধুরা অনেক সময় খাবার বা প্রয়োজনীয় বাজার সদাই করে দরজার বাইরে রেখে চলে যান।হায়রে করোনা!  তোমার জন্য আজ কারও যেন নেই করুনা। সবাই দূরে দূরে। এই দম্পতি জীবন বাঁজি রেখেই চলছে। স্বামী ও মৃত্যু ভয় করেননি। আর এই সন্তানটি শিখে নিয়েছেন বাস্তবতা
আমি এবং চ্যানেল এস এর ফরেন অ্যাফিয়ারস এডিটর তানভির আহম্মেদ। দুজনে অনেক সাহস নিয়েই এই করোনা রোগীর সাক্ষাৎকার আনতে যাই।আমাদের দেখেই ছোট্ট ছেলেটা ড্রইং রুমের জানালার পর্দা সরিয়ে আমাদের দেখছিলো। মা হাসপাতালে যাওয়ার পর সে এমনি করে তাকিয়ে থাকতো।মা কখন আসবে? হয়তো মা ফিরে না আসলে এভাবেই মায়ের জন্য অপেক্ষা করতে হতো জীবন ভর। কলিং বেলের আওয়াজ পেলেই আগে দৌড়ে সামনে আসতো আর এখন দূর থেকে শুধু চেয়ে থাকে এটা এই করোনা তাকে শিক্ষিয়েছে। করেনা শিখিয়েছে সামাজিক দূরুত্ব ।
শিরিন আব্দুর এই কথা গুলি বারবার বলছিলেন। “সাহস, সতর্কতা, আত্মবিশ্বাস , পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকা। লেবু, গরম পানি, সহ অন্যান্য ঔষধী খাবার যা রোগ প্রতিরোধ বাড়ায় সেই সব খাবার খাওয়া এবং সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রোগীকে অবহেলা এবং ঘৃনা না করা”।
আমরা যথেস্ট সতর্কতার সাথে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখেই স্বাক্ষাৎকার শেষ করলাম। অফিসে নিউজ দিয়ে বাসায় আসার পর যখন বললাম “করোনা রোগীর স্বাক্ষাৎকরের জন্য তার বাসায় গিয়েছিলাম”। এ কথা শুনে আমার স্ত্রীর চোখ কপাল উঠেগেলো।  আমাকে বললো “তুমি কি করোনা রোগীর বাসায় গিয়ে ছিলে ?” আমার নিরব উত্তরে অবশ্য বুঝেছেন। আমরা যথেস্ট সতর্কতা নিয়েই ইন্টারভিউ করেছি। অফিসেও অনেকে বলেছে “একটু বেশী হয়ে গেল না”। কিন্তু আমাদের দায়িত্বই হচ্ছে সংবাদ সংগ্রহ করে , মিডিয়ায় তুলে ধরা। যত কিছুই দায়িত্ব পালনে অবহেলা নয়।
রোগীকে নয় রোগ কে ঘৃনা করুন। যে কারও রোগ হতে পারে। আমাদের সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। যে সব খাবার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় সেই খাবার গুলি বেশী বেশী খাওয়া । এখানে আমরা ভজষ খাদ্য গুলিকে বেশী প্রাধান্য দিতে পরি।সেই সাথে পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা বেশী জরুরী।
এই পরিবারটিকে এই জন্য শ্রদ্ধা করি, সন্মান জানাই কেননা কেউ কাউকে ফেলে দেয়নি বা ফেলে যায়নি।হয়তো সম্রাট শাহজাহেনের মতো তাজ মহল বানাতে পারেননি তবে তাদের মনের মাঝে বহু গুন বেশী ভালোবাসা আছে। বিপদে একে অপরের পাশে আছে এবং থাকবে ।
অন্যদিকে আমরা দেখেছি, আপন মাকে করোনা সন্দেহে জঙ্গলে ফেলে চলে গেছেন। স্বামী বিদেশ থেকে আসার খবর পেয়ে স্ত্রী পালিয়ে গেছে। বিদেশ থেকে গিয়েছেন করোনার সন্দেহে বাড়ীতে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় নাই। করোনা মৃত্যু লাশ অনেক পরিবারই গ্রহন করেনি। এই মৃত্যুর পর লাশ ছুঁয়েও দেখেনি তার আত্মীয় স্বজন ও প্রতিবেশীরা। স্ত্রী , ছেলে,কন্যাদের কান্না দেখেও মন গলেনি তাদের।এমনকি করোনা রোগীকে হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়নি। এমন বহু নজির আছে।
আমরা নিজের জীবনকেই বেশী ভালোবাসি।আর ভুলে যাই অন্য সবাইকে। এই মহামারি করোনা এক দিন থেমে যাবে। কিন্তু ভালোবাসা রয়ে যাবে অনন্তকাল।