প্রচ্ছদ ধর্ম ‘ঈদ’ শব্দটি মুসলমানদের হৃদয়ে এক ঝঙ্কার তোলে

‘ঈদ’ শব্দটি মুসলমানদের হৃদয়ে এক ঝঙ্কার তোলে

0
ড. হাফেজ এ বি এম হিজবুল্লাহ: ‘ঈদ’ আরবি শব্দ। অর্থ ফিরে আসা। প্রতি বছর দুইবার ঈদ পালিত হয়। শব্দটি আরবি হলেও মুসলিম জাতির জীবনের সাথে জড়িয়ে আছে ওতপ্রোতভাবে। পৃথিবীর যেখানেই মুসলিম আছে, সেখানেই আছে এ শব্দটি। শব্দটির কোনো ভৌগোলিক সীমানা নেই। কোনো ভাষার সাথেও শব্দটি সীমাবদ্ধ নয়। তাই ‘ঈদ’ শব্দটি মুসলমানদের হৃদয়ে এক ঝঙ্কার তোলে। শিহরিত হয় দেহ-মন। অশান্ত মনে প্রশান্তির শীতলতা অনুভূত হয়।
আবহমান কাল থেকেই মানব জনপদে বিভিন্ন ধরনের লোকজ সংস্কৃতির প্রচলন ছিল। এখনো তা অব্যাহত রয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন জনপদে, জাতিতে, সম্প্রদায় ও ধর্মে পালিত হয়ে আসছে বিভিন্ন উপলক্ষকে কেন্দ্র করে নানা ধরনের বার্ষিক উৎসব। নানা কিসিমের ও বৈচিত্র্যের সমাহার দেখা যায় সে সব উৎসবে। আনন্দ-উল্লাস, ভোগ-বিলাস সব কিছুর আয়োজন থাকে উৎসবগুলোতে। ধর্মীয় উৎসবগুলোতে চেষ্টা করা হয় ধর্মীয় আবহ সৃষ্টির। ঋতুকেন্দ্রিক উৎসবগুলোতে ফুটে ওঠে ভিন্ন আমেজ।
আরবরা এর ব্যতিক্রম ছিল না। তদেরও উৎসব ছিল। নবী সা: মদিনায় তাশরিফ আনলেন। জানতে পারলেন, মদিনাবাসীর জন্য বছরে দুু’টি দিন রয়েছে, যে দিনগুলোতে তারা খেলাধুলা করে আনন্দ উপভোগ করে। জিজ্ঞেস করলেন, এ দু’টি দিন কিসের? তারা বলল, জাহেলি যুগে আমরা এ দিনগুলোতে খেলাধুলায় আনন্দ উদযাপন করতাম। তখন নবী সা: বললেন, আল্লাহ তোমাদের জন্য এর চাইতে উত্তম দু’টি দিন দান করেছেন; ফিতরের দিন এবং নাহরের (কোরবানি) দিন’ (আহমাদ : মুসনাদ, আবু দাউদ : সুনানা)।
তারই ধারাবাহিকতায় ইসলামে পালিত হয়ে আসছে ‘ঈদ’ উৎসব। শিক্ষণীয় বিষয় হলো, নবী সা: তাদের এ আনন্দ উৎসবে বাধা দেননি। দু’টি উপলক্ষকে কেন্দ্র করে উদযাপিত হয় ঈদ আনন্দ-উৎসব। এক. সিয়াম তথা রোজা শেষে। এর নাম ‘ঈদুল ফিতর’। দুই. হজরত ইবরাহিম আ:-এর পুত্র হজরত ইসমাঈল আ:কে কোরাবানির স্মরণে। এর নাম ‘ঈদুল আজহা’। দু’টি ঈদের ভিন্ন ভিন্ন তাৎপর্য থাকলেও শিক্ষা এক ও অভিন্ন। আর তা হলো, ঈদ মানে নিছক বিনোদন নয়। নিরেট ভোগ-বিলাস নয়। আনন্দ উদযাপনের নামে গুনাহে গা ভাসিয়ে দেয়া নয়। ইসলামে ঈদের শিক্ষা হলো, তাওহিদের শিক্ষা; নেয়ামতের শোকরগুজারির শিক্ষা; সহমর্মিতার শিক্ষা, পবিত্র ও নির্মল আনন্দ-বিনোদনের শিক্ষা।
ঈদুল ফিতর। দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর মাওলার পক্ষ থেকে জিয়াফতের আয়োজন করা হয়। তাই সেদিন রোজা রাখা হারাম করা হয়েছে। হজরত আবু হুরাইরা ও আবু সাঈদ খুদরি রা: থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা: দু’দিন রোজা রাখতে নিষেধ করেছেন, ঈদুর ফিতর ও ঈদুল আজহার দিন’ (বুখারি : ১১৯৭ ও মুসলিম : ২৭২৮)। তাই এক মাস পানাহার থেকে বিরত থাকার পর এ দিন মিষ্টি বা কিছু মুখে দিয়ে ঈদগাহে যেতে বলা হয়েছে। আর কোরবানির ঈদে কোরবানিকৃত পশুর গোশত দিয়ে ইফতার করতে বলা হয়েছে। অর্থাৎ ঈদের সালাত আদায়ের পর। হজরত বুরাইদা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা: ফিতরের দিন কিছু না খেয়ে বের হতেন না এবং কোরবানির দিন (ঈদগাহ থেকে) ফিরে না এসে কিছু খেতেন না’ (ইবনে মাজাহ : ১৭৫৬)। হজরত আনাস বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: ফিতরের দিন কয়েকটি খেজুর না খেয়ে বের হতেন না। তিনি আরও বলেন, বেজোড় সংখ্যায় খেজুর খেতেন’ (বুখারি : ৯৫৩)।
ঈদুল ফিতরের রয়েছে অনেক বৈশিষ্ট্য। যেমন রমজান শেষে খুশির বার্তা নিয়ে আসে ঈদ। এ মাসে কুরআন নাজিলের সূচনা হয়েছে। আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘রমজান মাস যে মাসে কুরআন অবতীর্ণের সূচনা হয়’ (বাকারা)। এ মহান মাসে এক পবিত্রতম রাতে কুরআন নাজিলের সূচনা হয় তাকে বলা হয় ‘লাইলাতুল কদর’ (সম্মানিত বা ভাগ্যের রাত) যে রাতের ইবাদত হাজার (অসংখ্য) রাতের ইবাদতের চেয়েও বেশি উত্তম। এ রাতকে ‘লাইলাতুম মুবারাকা’-ও (বরকতময় রাত) বলা হয়। বলা হয় ভাগ্যের রাত। মাসব্যাপী আল্লাহর হুকুম পালন করেছে বান্দা। তাই এ দিন আল্লাহ তাঁর বান্দাদের সম্মানিত করবেন এটাই স্বাভাবিক। আর এ সন্মান দিয়েছেন ঈদের সালাত আদায়ের মাধ্যমে আল্লাহর সামনে দুই রাকাত সালাত আদায়ের মাধ্যমে। প্রতি রাকাতেই আছে অতিরিক্ত তাকবির যা আল্লাহর প্রতি বান্দার আনুগত্যের প্রকাশ ঘটায়। এদিন বান্দা সারা মাস দিনের বেলা পানাহার ও জৈবিক চাহিদা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ থেকে মুক্তি লাভ করে উদ্বেলিত হয়। মাসব্যাপী আল্লাহর নির্দেশ মান্য করতে পেরে অন্তরে এক অনাবিল প্রশান্তি অনুভব করে। বান্দা এ মাসে শুধুই যে পানাহার থেকে বিরত থেকেছে এমনটি নয়; বরঞ্চ এর পাশাপাশি বিভিন্ন আমলের মাধ্যমে ঈমানি শক্তিকে বৃদ্ধি করেছে। গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার প্রাণান্তকর চেষ্টা-সাধনা করে গুনাহমুক্ত জীবন রচনার প্রয়াস পেয়েছে। আল্লাহর সাথে সম্পর্ক মজবুত করে এগিয়ে চলার প্রত্যয় গ্রহণ করেছে। তাই ঈদুল ফিতর মুসলিম জীবনে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে।
আহ্! ঈদুল ফিতরের আনন্দই অন্যরকম। সবাই সিয়াম সাধনার পর এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। ঈদের দিন সর্বোত্তম (নতুন হওয়া শর্ত নয়) পোশাকে ঈদগাহে উপস্থিত হয়ে রাব্বে কারিমের সামনে দুই রাকাত সালাত আদায় করে। বিগত দিনের পাপ-পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত হয়ে পূত-পবিত্রতার সবক গ্রহণ করে। এতেই রোজাদরের সামনে এক অনুপম প্রশান্তির দ্বার উন্মোচিত হয়। জান্নাতের রাইয়ান দরজা তাদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে কখন রোজাদার তাকে অতিক্রম করে জান্নাতে প্রবেশ করবে।
ঈদের দিন রোজাদার একে অপরকে ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়ে বলে, তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকা। (আল্লাহ আমাদের ও আপনার আমল কবুল করুন)। গরিব দুঃখীদের ভুলার কোনো সুযোগ নেই। তাদের জন্য ফিতরার ব্যবস্থা রয়েছে। ঈদের আগেই যা প্রাপককে পৌঁছে দিতে হবে যেন সে-ও ঈদ উৎসবে শরিক হতে পারে। আত্মীয়-স্বজনদের সাথে দেখা সাক্ষাতের মাধ্যমে ঈদের আনন্দ ষোলকলায় পূর্ণতা লাভ করে।
এদিন রোজাদারদের জন্য রয়েছে আনন্দ উদযাপনের সুযোগ। যে আনন্দ হবে গুনাহমুক্ত। কিন্তু সেখানে থাকবে চিত্তবিনোদন। হতে পারে ঈদ সন্ধ্যা। থাকতে পারে নানা আয়োজন। যেখানে থাকবে ঈদের শিক্ষা। ঈদের সঙ্গীত পরিবেশিত হবে। শিক্ষামূলক আলোচনার মাধ্যমে পরবর্তী জীবনের দিকনির্দেশনা থাকবে। ছোটদের জন্য বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা যেতে পারে। মিডিয়াতেও প্রচার হতে পারে ঈদ উৎসবের সওগাত। হজরত আয়েশা রা: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আবু বকর আমার ঘরে প্রবেশ করলেন। আমার সামনে আনসারী দু’টি বাচ্চা মেয়ে তখন গান করছিল। তারা কিন্তু গায়িকা ছিল না। আবু বকর বললেন, রাসূলুল্লাহ সা:-এর ঘরে শয়তানের সঙ্গীত? দিনটি ছিল ঈদের দিন। তখন রাসূলুল্লাহ সা: বললেন, হে আবু বকর! প্রত্যেক জাতির জন্য রয়েছে ঈদ উৎসব। এটা আমাদের ঈদ উৎসব। অন্য বর্ণনা রয়েছে, দু’জন বাচ্চা মেয়ে দপ দিয়ে খেলা করছিল; (মুসলিম : ৮৯০)। এতে বোঝা যায়, ঈমান জাগানিয়া সঙ্গীত পরিবেশনে বাধা নেই।
তা ছাড়া বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলারও আয়োজন করা যেতে পারে যেন সবাই তাতে অংশগ্রহণ করে আনন্দে মেতে উঠতে পারে। যেমন হজরত আয়েশা রা: বর্ণনা করেন, ঈদের দিন কিছু নিগ্রো নবী সা:-এর সামনে ক্রীড়া প্রদর্শন করছিল। তিনি আমাকে ডাকলেন এবং আমি তাঁর কাঁধে মাথা রেখে তা উপভোগ করছিলাম। আমি নিজ থেকে সরে না আসা পর্যন্ত তা দেখছিলাম। (নাসায়ি : ১৫৭৬)। হ্যাঁ, আমাদের ইসলামেও রয়েছে বিনোদনের সুযোগ। বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্যমে এ ঈদ উৎসবকে ঘরে ঘরে ছড়িয়ে দেয়া যায়।
তবে মনে রাখতে হবে, ঈদ মানেই নিরেট উৎসব বা আনন্দ নয়। বরং ঈদ একটি ইবাদতও বটে। আমরা লক্ষ করলে দেখতে পাবো, ঈদের প্রতিটি কার্যক্রমে রয়েছে ইবাদতের ছোঁয়া। মহান রাব্বুল আলামিন একমাস বান্দাকে বিশেষ এক ইবাদতের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাকে জান্নাতের উপযোগী করে সম্মানিত করেছেন। পুরো মাস গুনাহ থেকে মুক্ত থাকার শিক্ষা দিয়েছেন। ইবাদতে মশগুল থাকার সবক শিখিয়েছেন। সর্বোপরি মাওলার সন্তু‘ষ্টি অর্জনের পথ বাতলিয়েছেন। আর এখানেই রয়েছে একজন রোজাদারের সফলতা। আল্লাহ আমাদের তাঁর নেক বান্দাদের মাঝে শামিল করুন।
লেখক : অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া