প্রচ্ছদ প্রবন্ধ আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠা দিন : স্মৃতির আঙিনায় বেঁচে থাকবে আজীবন

আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠা দিন : স্মৃতির আঙিনায় বেঁচে থাকবে আজীবন

0
শাহনাজ সুলতানা: সময়টা ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি। শরীফ ভাই (সুরমার স্পোর্টস ও ক্রিকেট সংবাদ ডটকমের এডিটর মুহাম্মাদ শরীফুজ্জামান) একদিন ফোনে বললেন ‘কবি লন্ডন প্রেসক্লাব ফুটবল টুর্ণামেন্টে আপনাকে ‘সুরমা রাইডার্স’ টিমের ম্যানেজার ঠিক করেছি। খুব শীঘ্রই সালেহ ভাইয়ের (সালেহ আহমদ , আইটি সেক্রেটারি, লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাব) কাছে আমাদের টিম সদস্যদের তালিকা দিব’। কথাটা শুনে অবাক হয়েছিলাম, সেদিন পাগলের মতো হেসেছিলাম অনেকক্ষণ। হাসি শুনে শরিফ ভাই বললেন ‘আপনি হাসছেন কেন বুঝতে পারছি না’। হাসিটাকে কন্ট্রোল করে উত্তরে বলেছিলাম শরিফ ভাই ফুটবল টিমের ম্যানেজার আমাকে বানাবেন, আমি তো ফুটবল খেলা অতো বেশি বুঝি না। ছেলেদের টিমে নারী ম্যানেজার কেমন জানি দেখায়, লোকে শুনলে হাসাহাসি করবে। উত্তরে শরীফ ভাই বলেছিলেন, ‘আরে ভাই, মেয়েরা আজ সব পেশায় নিয়োজিত, কোথায় নেই নারীদের পদচারনা?। সমাজের অনেক বাঁধা বিপত্তি পেরিয়ে চারদিকে নারী অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছে সেই কবে থেকে। সম্প্রতি বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যান্ড এক্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) সভাপতি পদে এবারই প্রথম একজন নারী নির্বাচিত হয়েছেন। অন্য বড় কোম্পানিগুলোতে কর্মরত নারীদের কথা না-ই বা বললাম। আপনি ফুটবল টিমের ম্যানেজার হলে অসুবিধা কোথায়? লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাবে আমরা-ই প্রথম আপনাকে দিয়ে সূচনা করব। দেখবেন আগামীতে আরো নারীরা এগিয়ে আসবেন। আপনি শুধু দু’একটা প্যাকটিস ম্যাচে উপস্থিত থেকে আমাদের খেলা দেখবেন। কথাগুলো শুনে সে দিন শরীফ ভাইকে না বলতে পারিনি, রাজি হয়ে গেলাম।

প্রেসক্লাব ফুটবল টুর্নামেন্টের দিনক্ষণ যতোই ঘনিয়ে আসছিলো নিজের ভেতর উৎসাহের ভ্রুণ ডালাপালা মেলতে শুরু করল এই ভেবে যে, লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাবে এই প্রথম কোন নারী ফুটবল টিমের ম্যানেজার হিসেবে খেলায় অংশ গ্রহণ করছেন আর সেই নারী হলাম আমি। যার হাত ধরে বাংলাক্লাবে নারী অগ্রযাত্রার নতুন এক মাত্রা যোগ হবে।
কয়েক সপ্তাহ অপেক্ষার পর প্রতিকূল আবহাওয়া, গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতে বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনার মধ্যে গত বছর ১৪ অক্টোবর ব্রিটেনে বাংলা মিডিয়ার প্রতিনিধিত্বকারী প্রধান সংগঠন লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাব সদস্যদের মধ্যে এলবিপিসি ৫ এ সাইড ফুটবল টুর্নামেন্ট ২০১৮ অনুষ্ঠিত হলো মাইলএন্ড স্টেডিয়ামে। নয়টি টিমের প্রতিযোগিতামূলক খেলায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ওয়ান বাংলা ফ্রেন্ডস ইউনাইটেড। রানার্সআপ হয়েছিল চ্যানেল এস। সেদিন সুরমা রাইডার্স টিম বিজয়ী হতে পারেনি তবে সারাদিন বৃষ্টিতে ভিজে বিভিন্ন টিমের খেলা উপভোগ করেছিলাম আমরা। একজন টিম ম্যানেজার হিসেবে আরো সঞ্চয় করেছিলাম নতুন এক অভিজ্ঞতা যা পরবর্তীতে কাজে লেগেছে।
সাপ্তাহিক সুরমা আমাদের প্রিয় আড্ডাস্থল। সময় ও সুযোগ হলে আমরা সুরমায় বসি, কবিতা ও সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করি। গত বছর জুন মাসে শেষের কোন এক রোববারে বন্ধুরা মিলে আড্ডা দিচ্ছিলাম সুরমায়। হঠ্যাৎ শরীফ ভাই বললেন, কবি জরুরী আলাপ আছে। জানতে চাইলাম কিসের আলাপ। বললেন গতবারের মতো এবারো বাংলা মিডিয়াতে কর্মরত সাংবাদকর্মীদের নিয়ে আয়োজিত হচ্ছে টি ১০ মিডিয়া ক্রিকেট টুর্নামেন্ট ২০১৯। আগামী ২৪ আগস্ট শনিবার পূর্ব লন্ডনের হ্যাকনী মার্স মাঠে এ খেলা অনুষ্টিত হবে। ক্যানারী ওয়ার্ফ গ্রুপের অর্থায়নে এবং লন্ডন ক্রিকেট লীগ ও লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবের সার্বিক সহযোগিতায় নয়টি দল দুই গ্রুপে ভাগ হয়ে লীগ পদ্ধতিতে খেলবে। দুই গ্রুপের শীর্ষ ২টি করে দল শিরোপার জন্য নক আউট পর্যায়ে অংশ নেবে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে একই দিন বিকেলে ফাইনাল খেলা অনুষ্ঠিত হবে। মিডিয়া ক্রিকেট টুনামেন্টে আমরা খেলবো। আমাদের টিমের নাম হচ্ছে ‘এসপিডি’ । এমাদ ভাই (এমদাদুল হক চৌধুরী, ক্লাব সভাপতি ও সম্পাদক সাপ্তাহিক পত্রিকা ) সহ আমরা সবাই মিলে ঠিক করেছি আপনি হবেন আমাদের টিমের ম্যানেজার । বললাম আবারো আমি, ‘এসপিডি’ নামের অর্থ কি? জবাবে বললেন তিনটি পত্রিকা মিলে (সাপ্তাহিক সুরমা, পত্রিকা, দেশ) একটি টিম। তাই তিনটি পত্রিকার নামের আদ্যক্ষর নিয়ে এই নাম ঠিক করা হয়েছে।
সবকিছু শুনে বললাম শরীফ ভাই ক্রিকেট খেলা দেখি কিন্তু বুঝি কম। তাছাড়া ফুটবল এবং ক্রিকেট দুটো খেলার এক ম্যানেজার হয় কি করে? শরীফ ভাই বললেন আমরা তো প্রফেশনাল খেলোয়াড় নই ভাই, আমরা বিশ্বকাপে খেলছি না। আমরা খেলছি আমোদ ফুর্তি করার জন্য। বাংলাক্লাবের সবাই মিলে একটি দিন ভালোভাবে উদযাপনের জন্য। যেহেতু ক্রিকেট টুর্নামেন্টে নারীদের কোন টিম নেই আমরা চাচ্ছি ম্যানেজার হিসেবে আপনার অংশগ্রহণ থাকুক। দ্বিধা দ্বন্ধে না ভোগে আপনাদের এগিয়ে আসা উচিত। ক্লাবে ব্যালেন্স থাকা প্রয়োজন। সবশেষে বললেন, আরে কবি অতো বেশি ভাববেন না তো ফুটবলের মতো ক্রিকেটও বুঝে যাবেন। শুধু প্যাকটিস ম্যাচে উপস্থিত হতে হবে। শরীফ ভাইয়ের সাথে কাইয়্যুম ভাই ( কাইয়্যুম আবদুল্লাহ , বার্তা সম্পাদক সাপ্তাহিক সুরমা) ও সুর মিলিয়ে বললেন অতো বেশি ভাবার কি আছে? তুমি-ই হলে এসপিডি টিমের ম্যানেজার। দুই বন্ধুর কথায় সেদিন আবোরো রাজি হয়ে গেলাম ম্যানেজার হতে।

গত বছর জুন এবং আগষ্টের মাঝখানে খেলাকে কেন্দ্র করে বেশ কয়েকটি মিটিং হলো । বোনের বিয়েতে বেশ কয়েকদিন দেশে ছিলাম তাই সব ক’টি মিটিংএ উপস্থিত হতে পারিনি। আমাদের টিমের পক্ষ থেকে রিপ্রেজেন্টটেটিভ হিসেবে মাঝেমধ্যে সাপ্তাহিক দেশ সম্পাদক তাইসির মাহমুদ উপস্থিত ছিলেন। আমি বাংলাদেশ থেকে ফিরে আসার দুদিন পর শরীফ ভাই ফোনে বললেন – কবি বলেছিলাম না আরো নারীরা এগিয়ে আসবেন? এবারের মিডিয়া ক্রিকেট টুর্নামেন্টে আরো দু’জন নারী ম্যানেজার যোগ দিচ্ছেন। একজন হলেন উর্মি মাযহার, টিম এটিএন বাংলা অন্যজন হচ্ছেন আনঞ্জুমান মুন্নী, টিম বেতার বাংলা। উত্তরে বললাম, আমাদের নারীদের জন্য এরচেয়ে বড় সুখবর আর কি হতে পারে শরীফ ভাই? শুধুমাত্র ব্রিটেন কেন বিশ্বের অন্য কোন দেশে এখনো পর্যন্ত কোন খেলায় তিনজন নারী ম্যানাজার একসাথে যোগ দিয়েছেন বলে মনে হয় না। জয়তু টি ১০ ক্রিকেট মিডিয়া কাপ ২০১৯, জয়তু লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাব।
টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হবার একদিন আগে প্রাকটিস ম্যাচের আয়োজন করা হলো ভিক্টোরিয়া পার্কে। টিম মেনটর উদয় শংকর দাশসহ সবাই উপস্থিত হয়েছিলাম পার্কে খেলা দেখার জন্য। সবাইকে উৎসাহ দিতে সেদিন পার্কে উপস্থিত হয়েছিলেন প্রেসক্লাব সভাপতি এমদাদুল হক চৌধুরী গরম বিরিয়ানি এবং পানি নিয়ে। সে দিনের বিকেলটা সত্যি ভীষণ উপভোগ করেছিলাম আমরা।
যাই হোক, দীর্ঘ অপেক্ষার পর গত ২৪ আগষ্ট নয়টি টিমের অংশগ্রহণে হ্যাকনি মার্সে অনুষ্ঠিত হলো টি ১০ মিডিয়া কাপ ২০১৯ । বিভিন্ন টিম ম্যানেজার হয়ে এই প্রথম কোন খেলায় প্রেসক্লাব থেকে একসাথে তিনজন নারী অংশগ্রহণ করেছিলাম। সবার মুখে হাসি ফুটে উঠেছিলো ঠিকই কিন্তু নিজ টিম জয়ী হবার আপ্রাণ চেষ্টার কমতি ছিলো না আমাদের। শুধু ক্লাব সদস্যরা নন ফেসবুক এবং বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় তিনজন নারীর অংশগ্রহণের ছবি ও খবর পড়ে অনেকেই প্রশংসা করেছেন অভিনন্দন জানিয়েছেন ব্যক্তিগতভাবে, ইনবক্স ও টেক্স ম্যাসেজের মাধ্যমে।
বাংলাক্লাবে নারীদের আরো বেশি সম্পৃক্ত করতে ক্লাব সভাপতিসহ বিভিন্ন মিডিয়া হাউজের সম্মিলিত এই উদ্যোগকে অনেকেই স্বাগত জানিয়েছেন। আমরা আশাবাদী আগামীতে আরো নারীরা এগিয়ে আসবেন সম্পৃক্ত হবেন ক্লাবের বিভিন্ন কর্মকান্ডে।
পরিশেষে এটুকু বলবো জয় পরাজয় বড় কথা নয় । সবচেয়ে বড় আনন্দের এবং উপভোগের ছিলো সবার অংশগ্রহণে মুখরিত ঐ দিনটি। রোদ্রজ্জ্বল দিনে হ্যাকনি মার্সে বিভিন্ন রঙের জার্সি পরা ম্যানাজার, টিম মেম্বার ও ক্লাব সদস্যবৃন্দ ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের হাসি উল্লাসে মেতে উঠা দিন সত্যি স্মৃতির আঙিনায় বেঁচে থাকবে আজীবন।