প্রচ্ছদ ধর্ম পবিত্র হজ পালিত : লাব্বাইক ধ্বনিতে মুখর আরাফাত

পবিত্র হজ পালিত : লাব্বাইক ধ্বনিতে মুখর আরাফাত

0

‘লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হাম্‌দা ওয়ান্‌নি’মাতা লাকা ওয়াল মুল্‌ক, লা শারিকা লাক’ (আমি হাজির, হে আল্লাহ আমি হাজির, তোমার কোনো শরিক নেই, সব প্রশংসা ও নিয়ামত শুধুই তোমার, সব সাম্রাজ্যও তোমার, তোমার কোনো শরিক নেই) ধ্বনিতে গতকাল বৃহস্পতিবার মুখরিত হলো পবিত্র আরাফাত ময়দান। বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে আসা লাখো ধর্মপ্রাণ মুসল্লির কণ্ঠে উচ্চারিত হলো মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে আত্মসমপর্ণের এই পবিত্র বাণী।

পাপমুক্তি ও আত্মশুদ্ধির আকুল বাসনা নিয়ে ২০ লাখের বেশি ধর্মপ্রাণ মুসলমান গতকাল পবিত্র হজ পালন করেছেন। সূর্যোদয়ের পর হাজিরা সৌদি আরবের মিনা থেকে ট্রেনে-বাসে বা হেঁটে রওনা হন আরাফাতের ময়দানের উদ্দেশে।

হজের দিনে (৯ জিলহজ) এ ময়দানে অবস্থান করা হজ পালনকারীদের জন্য তিনটি ফরজের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এ ময়দানেই মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বিদায় হজের ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন। মূলত ৯ জিলহজ আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করাই হজ। ১২ জিলহজ হজের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হবে।

গত মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর থেকেই হাজিরা ইহরাম বেঁধে ‘লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’ ধ্বনি উচ্চারণ করে পবিত্র মক্কা নগরী থেকে মিনার উদ্দেশে রওনা দেন। আর এর মধ্য দিয়েই শুরু হয় হজের মূল আনুষ্ঠানিকতা। এরপর গতকাল মিনা থেকে তাঁরা সমবেত হন আরাফাতের ময়দানে। তাঁরা সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত এ ময়দানে অবস্থান করেন। কেউ পাহাড়ের কাছে, কেউ সুবিধাজনক জায়গায় বসে দিনভর ইবাদত করেন। কেউ যান জাবালে রহমতের (রহমতের পাহাড়) কাছে মসজিদে নামিরাহ থেকে হজের খুতবা দেন সৌদি আরবের গ্র্যান্ড মুফতি আবদুল আজিজ আল শাইখ।

মিনার মতো আরাফাতেও তাঁবুর সারি। তবে এগুলো অস্থায়ী।

পবিত্র কোরআন, হাজি ম্যাট ও টুকিটাকি ব্যবহার্য সামগ্রী নিয়ে বাসে ওঠার কিছুক্ষণের মধ্যেই আরাফাতের ময়দানে পৌঁছে গেলাম। ছোট ছোট গাছের ফাঁকে হাজারো তাঁবুর সারি। কিছু পরপর অজুর ব্যবস্থা ও শৌচাগারের সুবিধা। ফজরের নামাজ তাঁবুর ভেতরে জামাতের সঙ্গে পড়লাম।

প্রতিটি তাঁবুর সামনে খাওয়ার পানির পাত্র। অনেকে ট্যাপ থেকে পানি নিয়ে গোসল সারলেন। বেশির ভাগ মোয়াল্লেম হাজিদের বিরিয়ানি রান্না করে খাওয়ান। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ফাস্ট ফুডের প্যাকেটও বিতরণ করা হয়।

হজ ভিসা নিয়ে যাঁরা সৌদি আরবে গিয়ে অসুস্থতার জন্য হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন, তাঁদেরও হজের গুরুত্বপূর্ণ এই ফরজ পালনে (আরাফাত ময়দানে উপস্থিতি) অ্যাম্বুলেন্সে আরাফাত ময়দানে স্বল্প সময়ের জন্য আনা হয়েছিল।

আরাফাত মিনা থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে। এই ময়দানে অবস্থিত মসজিদে নামিরাহতে জামাতে অংশগ্রহণকারীরা এক আজান ও দুই ইকামতের সঙ্গে একই সময়ে পরপর জোহর ও আসরের নামাজ আদায় করেন। নামাজের আগে ইমাম সাহেব খুতবা দেন। যাঁরা এ মসজিদে নামাজের জামাতে শামিল হতে পারেননি তাঁরা নিজ তাঁবুতে জামাতে নামাজ আদায় করেন।

গতকাল সূর্যাস্তের পর আরাফাত ময়দান থেকে মুজদালিফার উদ্দেশে রওনা দেন হাজিরা। মুজদালিফা অর্থ নৈকট্য লাভ করা। হজরত আদম (আ.) ও বিবি হাওয়া তাঁদের প্রথম দেখা হওয়ার পর এই মুজদালিফায় খোলা আকাশের নিচে রাত কাটিয়ে ছিলেন বলে জানা যায়।

সূর্যাস্তের পর মুজদালিফামুখী পথে হাজিদের ঢল নামে। যুবা, বৃদ্ধ, নানা বর্ণ, নানা বয়সী নারী-পুরুষ সবাই এক উদ্দেশ্য ও এক গন্তব্যে চলেছেন। রাস্তার দুই ধারে উঁচু পাহাড়। রাস্তার পাশে কিছুদূর পরপর খাওয়ার পানির ট্যাপ।

আরাফাত ময়দান থেকে আবার বাসেই রওনা দিলাম। রাস্তার দুই পাশের মাঠ ও পাহাড়ে লাখো হাজি। খুব ধীরগতিতে অগ্রসর হতে হচ্ছিল। মুজদালিফায় যখন পৌঁছালাম রাত তখন প্রায় নয়টা। মাগরিব ও এশার নামাজ আদায় করলাম। আরাফাতের ময়দানে বা আরাফাত থেকে মুজদালিফা যাওয়ার পথে মাগরিবের নামাজের সময় হলেও নামাজ পড়া নিষেধ। মুজদালিফায় পৌঁছানোর পর মাগরিব ও এশার নামাজ একসঙ্গে পড়তে হয়। তারপর মুজদালিফার খোলা প্রান্তরে রাত কাটাতে হয়। জামারায় শয়তানের উদ্দেশ্যে পরপর তিন দিন ছোড়ার জন্য প্রয়োজনীয় পাথরের টুকরা এখান থেকেই সংগ্রহ করতে হয়। ছোট ছোট ৭০টি পাথর সংগ্রহ করলাম। এরপর আমরা একটু বিশ্রাম নিলাম। ইহরাম বাঁধা অবস্থায় মুখ ও মাথা ঢাকা নিষেধ।

সবাই খোলা আকাশের নিচে। কেউ নামাজ পড়ছেন, কেউ শুয়ে আছেন, কেউ ঘুমাচ্ছেন। হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে এক স্থানে হাজির সবাই।

হাজিরা আজ শুক্রবার মিনার তাঁবুতে ফিরবেন। বড় শয়তানকে সাতটি পাথর মেরে, কোরবানি শেষে মাথার চুল ছেঁটে বা মাথা মুড়িয়ে স্বাভাবিক পোশাকে মিনা থেকে পবিত্র মক্কায় ফিরে তাওয়াফ করবেন (কাবা শরিফ সাত চক্কর দেওয়াকে তাওয়াফ বলে) হাজিরা। জমজমের পানি পান করবেন। সাফা-মারওয়া পাহাড় সাতবার প্রদক্ষিণ করে হজের অত্যাবশ্যকীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষ করবেন। এরপর তাঁরা আবার মিনায় ফিরে পরবর্তী দুই দিন সেখানে তিনটি শয়তানের উদ্দেশে পাথর ছুড়বেন। এভাবে হজের আনুষ্ঠানিকতা পুরোপুরি শেষ হবে।

মক্কায় বিদায়ী তাওয়াফের পর হাজিরা দেশে ফিরে যাবেন।

কাবা শরিফে নতুন গিলাফ

প্রতিবছর হজের দিন (৯ জিলহজ) হাজিরা আরাফাতের ময়দানে থাকেন এবং মসজিদে হারামে মুসল্লির সংখ্যা কম থাকে। তাই এদিন কাবা শরিফের গায়ে পরানো হয় নতুন গিলাফ। আরবরা পবিত্র কাবাকে আবৃত করে রাখা কাপড়টিকে বলে কিসওয়া। আমরা বলি গিলাফ। হাজিরা আরাফাত ময়দান থেকে ফিরে কাবা শরিফের গায়ে নতুন গিলাফ দেখতে পান। পুরোনো গিলাফ কেটে মুসলিম দেশগুলোর সরকারপ্রধানদের উপহার দেওয়া হয়।

এএফপিসহ বিভিন্ন বার্তা সংস্থার খবরে বলা হয়, ২০১৫ সালে মিনার জামারায় শয়তানের উদ্দেশে পাথর ছুড়তে যাওয়ার পথে ভিড়ে পদপিষ্ট হয়ে মারা যান কয়েক শ হাজি। গত ২৫ বছরের মধ্যে হজ পালনকালে এটাই ছিল সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা। সৌদি কর্মকর্তারা বলেন, তাঁরা পূর্বসতর্কতা হিসেবে এই বছর সব ধরনের নিরাপত্তামূলক পদক্ষেপ নিয়েছেন। হাজিদের নিরাপত্তা এবং প্রাথমিক চিকিৎসাসেবায় ১ লাখের বেশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য এবং ৩০ হাজার স্বাস্থ্যসেবী মোতায়েন করা হয়েছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here