প্রচ্ছদ সাহিত্য বাংলা সাহিত্য কতটা আন্তর্জাতিক?

বাংলা সাহিত্য কতটা আন্তর্জাতিক?

0
অলংকরণ: মাসুক হেলাল
হাসনাত আবদুল হাই: সম্প্রতি ঢাকায় আন্তর্জাতিক বাংলা সাহিত্য সম্মেলন হয়ে গেল। সেখানে যোগ দিতে পারিনি কিন্তু বিষয়টা নিয়ে কিছু চিন্তাভাবনা মাথায় এসেছে। একেবারেই আলটপকা চিন্তা, কোনো কিছু না পড়ে কিংবা কারও সঙ্গে আলোচনা না করেই; হঠাৎ মনে হলো, চিন্তাটা অন্যের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া যেতে পারে, যার জন্য এই নিবন্ধ।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্য আন্তর্জাতিকভাবে মর্যাদা পায় ভারত উপমহাদেশ স্বাধীন হলে, ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্টের পর। এর আগে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য ছিল উপমহাদেশের অন্যতম আঞ্চলিক ভাষা ও সাহিত্য। প্রাদেশিক বা আঞ্চলিক ভাষা থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বীকৃতি পাওয়া ছিল বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জন্য নিঃসন্দেহে গৌরবের। এটা যে দেশভাগের ফলে হলো, সেই কারণটি গৌরবের কি না, তা ভাববার বিষয়। তবে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে ‘আন্তর্জাতিক’ হয়ে ওঠার জন্য মূল্য দিতে হয়েছে।
সাতচল্লিশের আগস্টের পর পাকিস্তানের অন্যতম প্রদেশ পূর্ব পাকিস্তান এবং ভারতের অন্যতম রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের বাংলাভাষী নর-নারীর দৈনন্দিন জীবনে যোগাযোগের প্রয়োজন মেটানো ছাড়াও সাহিত্যচর্চার মাধ্যম হয়ে উঠে বাংলা ভাষা নতুন যে যাত্রা শুরু করল, দুই অঞ্চলে তা এক ও অভিন্ন ছিল না। পশ্চিমবঙ্গে বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চা আগে যেমন হয়েছে, স্বাধীনতালাভের পর সেই একই ধারায় অব্যাহত থেকেছে। কেবল দেশভাগজনিত বিভিন্ন বিষয়, বিশেষত জন্মভূমি ত্যাগ করে আসা মানুষের জীবনযাপনের সমস্যা—বিষয়ের দিক দিয়ে কিছু নতুন উপকরণ এনে লেখায় উপজীব্য করেছে। পূর্ব পাকিস্তান থেকে যেসব লেখক, যাঁদের বেশির ভাগ ছিলেন হিন্দু, পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে সাহিত্যচর্চা করেছেন, তাঁদের ব্যবহৃত ভাষায়, বিশেষত গল্প-উপন্যাসের সংলাপে, কোথাও কোথাও পূর্ববঙ্গের আঞ্চলিক ভাষা থেকে কিছু শব্দ যুক্ত হয়েছে। এ ছাড়া পশ্চিমবঙ্গের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে দেশভাগ বড় কোনো পরিবর্তন আনেনি। দেশভাগের আগে বাংলায় সাহিত্যচর্চা করতেন এমন মুসলমান লেখকের সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। এ কারণে তাঁরা পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসার ফলে কোনো শূন্যতার সৃষ্টি হয়নি। তবে দেশভাগের পরও যেসব মুসলমান পরিবার পশ্চিমবঙ্গেই থেকে যায়, তাদের নিয়ে লেখার মানুষ প্রায় শূন্যে এসে দাঁড়াল। কারণ, কথাসাহিত্যিক আবুল বাশার ও সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যে এসেছেন অনেক পরে। তাঁরাও মুসলমানদের জীবন নিয়ে সব গল্প-উপন্যাস লেখেননি। হিন্দু লেখকদের মধ্যে গৌরকিশোর ঘোষই মনে হয় একমাত্র সাহিত্যিক, যিনি মুসলমান চরিত্রকে প্রধান করে উপন্যাস লিখেছেন। পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যে মুসলিম জনগণের জীবন দেশভাগের আগে যেভাবে যতটুকু এসেছে, পরবর্তী সময়ে অনেকটা তেমনই রয়ে গেছে।
পূর্ব পাকিস্তান হওয়ার পর এখানে বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চা নতুনভাবে যাত্রা শুরু করে। সাতচল্লিশের আগের পর্বে ঢাকা থেকে প্রকাশিত ও বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত সাহিত্য পত্রিকা প্রগতিকোনো সাহিত্য আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি, একে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠেনি কোনো গোষ্ঠীও। আবার প্রায় একই সময়ে কাজী আবদুল ওদুদ, আবুল হুসেন, কাজী মোতাহার হোসেন, আবদুল কাদির প্রমুখ ঢাকাবাসী মুসলিম বুদ্ধিজীবী মুক্তবুদ্ধিচর্চার জন্য ১৯২৬ সালে গঠন করলেন একটি সংগঠন—মুসলিম সাহিত্য সমাজ, যা খ্যাত ছিল ‘শিখা গোষ্ঠী’ নামে। ওই গোষ্ঠীর মুখপত্র হিসেবে শিখা নামে একটি সাহিত্যপত্র প্রকাশিত হতো। তবে ঢাকা নওয়াব বাড়ির উর্দুপ্রীতির জন্য পত্রিকাটি একসময় বন্ধ হয়ে যায়। এরপর শিখা গোষ্ঠী ভেঙে যাওয়ার ইতিহাস অনেকেরই জানা।
এই বাস্তবতায় মনন ও সৃজনশীলতার চর্চা অব্যাহত না থাকায় একটা শূন্যতার মধ্যে দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে বাংলা ভাষার প্রসার ও সাহিত্যচর্চা শুরু হয়। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী নিজস্ব আদর্শে সংস্কৃতি গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে এবং ভারতের বিরুদ্ধে বিদ্বেষের জন্য প্রথম থেকেই বাংলা ভাষার ব্যবহার ও সাহিত্যচর্চা রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে আনার উদ্যোগ নেয়। প্রথম আঘাত এল ভাষার ওপর, যখন সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাভাষীর মাতৃভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি না দিয়ে উর্দুকেই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেওয়া হলো। ছাত্র-জনতার প্রতিবাদ, আন্দোলন ও রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলা শেষ পর্যন্ত অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি আদায় করে নেয়, যার রাজনৈতিক প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা স্বীকৃতি পেলেও এই ভাষাকে পশ্চিমবঙ্গের ভাষা থেকে পৃথক করার জন্য প্রকাশ্য ও গোপনে হাতে নেওয়া হলো কর্মসূচি। এই কর্মসূচির অন্যতম কৌশল ছিল বাংলা ভাষায় বেশি করে আরবি, উর্দু ও ফারসি শব্দের প্রচলন। সরকারি প্রচারমাধ্যমগুলোতে এই কর্মসূচির বাস্তবায়ন হতে থাকল সুপরিকল্পিতভাবে। সরকারের পক্ষ থেকে প্রকাশ করা হলো একটি বাংলা মাসিক সাহিত্য পত্রিকা, যার নাম ছিল উর্দুতে—মাহে নও; এর বাংলা অর্থ নতুন মাস। এই পত্রিকার মাধ্যমে পাকিস্তানের আদর্শভিত্তিক ভাষা ব্যবহার ও সাহিত্যচর্চা জনপ্রিয় করার চেষ্টা চলল। এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের আদর্শে বিশ্বাসী হলেও ‘তমদ্দুন মজলিশ’ নামের প্রতিষ্ঠানটি বাংলা ভাষা-সাহিত্যের বিকৃতির বিরুদ্ধে যে অবস্থান নিল, তা ছিল প্রশংসনীয়। একই সঙ্গে নবীন প্রজন্মের মুখপত্র ফতেহ লোহানী সম্পাদিত পত্রিকা অগত্যাপ্রকাশ্যে পাকিস্তান সরকারের বাংলা ভাষা-সাহিত্যে হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে অবস্থান নিল, দারুণ জনপ্রিয় হয়ে উঠল পত্রিকাটি। আবার সেই সময়ে কিছু লেখক পাকিস্তান সরকারের ভাষা ও সাহিত্যনীতির সমর্থনে পৃথক সাহিত্য সৃষ্টির উদ্যোগও নিলেন। নতুন সাহিত্য নামে কবিতা সংকলন হয়ে দাঁড়াল তাঁদের মুখপত্র। কিন্তু অধিকাংশ বাঙালি লেখক এই মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন না, অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শের আলোকে তাঁরা সাহিত্যচর্চা করলেন। এমনকি সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত বাংলা একাডেমিও কেন্দ্রীয় সরকারের ভাষা ও সাহিত্যনীতি অনুসরণ না করে নিজস্ব আদর্শের ভিত্তিতে গ্রহণ করল কর্মসূচি। এ সময় সত্যিকার অর্থেই বাংলা একাডেমি হয়ে উঠল বাংলা ভাষার উন্নতি সাধন ও সাহিত্যচর্চার সর্বাত্মক কাঠামো তৈরির প্রতিষ্ঠান, যা ছিল ভাষাশহীদদের সংগ্রামী চেতনার দাবি। ভয়ভীতিহীন হয়ে এবং কর্তৃপক্ষের অনুরাগের অপেক্ষায় না থেকে এ সময় প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি উদ্‌যাপন এবং একাডেমির সাংবাৎসরিক কর্মসূচি বাংলা ভাষার উৎকর্ষ সাধন ও সাহিত্যচর্চার প্রধান চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করে গেছে। ভাষা আন্দোলন ছাড়া এবং বাংলা একাডেমির প্রগতিশীল ভূমিকার অবর্তমানে পূর্ব পাকিস্তানে বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চা শুধু যে জনপ্রিয়তা অক্ষুণ্ন রাখতে পদে পদে বাধাগ্রস্ত হতো তা-ই নয়, ভাষা ও সাহিত্যের অগ্রগতি অর্জনেও পিছিয়ে থাকত। পশ্চিমবঙ্গের পাশাপাশি পূর্ব পাকিস্তানেও বাংলায় সাহিত্যচর্চা হচ্ছে—এই দাবির ভিত্তিতে আন্তর্জাতিকতার মর্যাদালাভ আনুষ্ঠানিক ঘোষণার বেশি কিছু হতে পারত না। সুতরাং বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিলাভের পেছনে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাভাষীদের ভূমিকা ছিল প্রধান।
এই পরম্পরায় ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে স্বাধীনতালাভের পর বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম জাতিসংঘে বাংলায় বক্তৃতা দিলেন। পরবর্তীকালে বাংলাদেশি ভাষাপ্রেমীদের উদ্যোগ ও বাংলাদেশ সরকারের তৎপরতায় একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পেল। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের মর্যাদা রক্ষায় এই ঐতিহাসিক ভূমিকা আরও তাৎপর্যপূর্ণ ও কার্যকর হয়েছে।
বাংলা ভাষায় এখন তিনটি অঞ্চলে সাহিত্যচর্চা হচ্ছে। প্রথমটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ, দ্বিতীয়টি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ তথা ‘বাংলা’ রাজ্য এবং তৃতীয় স্থানটি হলো বিশ্বের যেসব দেশে বাংলাভাষী পরিবার অভিবাসী হিসেবে বসবাস করছে।

বাংলাদেশে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ ইতিহাস এবং রাষ্ট্রভাষা হিসেবে এর স্বীকৃতি সত্ত্বেও স্বীকার না করে উপায় নেই যে সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় লেখার সংখ্যার ভিত্তিতে বাংলাদেশ এখনো পশ্চিমবঙ্গের পেছনে রয়ে গেছে। কথাটির ব্যাখ্যায় বলা যায়, পশ্চিমবঙ্গে সাহিত্যিকেরা যে ঐতিহ্য অনুসরণ করছেন, তা খুব পুরোনো, যে কারণে তাঁদের পক্ষে লেখার সংখ্যায় ও বিষয়-বৈচিত্র্যে এগিয়ে থাকা সম্ভব হয়েছে। এটা একটা গ্রহণযোগ্য যুক্তি বটে। কিন্তু এ ছাড়া বড় কারণ হলো, পশ্চিমবঙ্গে অনেক লেখক যেমন পেশা হিসেবে বাংলায় সাহিত্যচর্চা গ্রহণ করতে পেরেছেন, বাংলাদেশে এখনো সেই বাস্তবতা তৈরি হয়নি। এই পার্থক্য দূর করতে না পারলে সাহিত্যচর্চায় বাংলাদেশ পেছনে পড়ে থাকবে, এ কথা বলা যায়।

সমস্যার সমাধান কীভাবে হবে, তা জানি না। কিন্তু আমাদের সবাইকে এ বিষয়ে অবহিত থাকতে হবে। তা না হলে আন্তর্জাতিকতার মর্যাদা অর্জনে আমাদের ভূমিকা প্রধান, এই আনুষ্ঠানিক দাবি করার বেশি কিছু আশা করা হয়তো বাতুলতা হবে। এ ক্ষেত্রে বাংলা একাডেমি ও প্রকাশকমণ্ডলীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তাঁরা তাঁদের করণীয় গুরুত্বের সঙ্গে ভেবে দেখলে অবস্থার উন্নতি হতে পারে।

বাংলা ভাষা আন্তর্জাতিকতার মর্যাদা পেয়েছে একাধিক দেশে (বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, বাঙালি অভিবাসীদের বসবাসের দেশগুলো) ব্যবহৃত হওয়ার জন্য, এ কথা বলাই বাহুল্য। কিন্তু তিনটি স্থানেই বাংলা ভাষা যে সব দিক দিয়ে এক ও অভিন্ন হবে, এমন বলার উপায় নেই। দেশগুলোর (বাংলাভাষীদের বসবাসের স্থানকে সরলভাবে ‘দেশ’ বলা হচ্ছে) সামাজিক, রাজনৈতিক ভিন্নতার জন্য ভাষাতেও কিছু বিশেষত্ব থাকবে, যা নির্ধারণ করবে—করছেও—একের সঙ্গে অন্যের ব্যবহৃত ভাষার ভিন্ন চেহারা। এই ভিন্নতা বড় ধরনের হবে না। কেননা, ভাষার যে প্রধান ভিত্তি ব্যাকরণ, তার বিস্তর পরিবর্তন তো সম্ভব নয়; যা পরিবর্তিত হয়েছে ও হবে, তা অভিধানের শব্দসম্ভারে। শুধু দেশীয় নয়, আন্তর্জাতিক অন্য ভাষাগুলো থেকেও নতুন শব্দ সংযোজিত হবে বাংলা ভাষায়, যেমন হয়ে এসেছে এতকাল। বাংলা ভাষাকে ‘আন্তর্জাতিকতা’র অভিধায় আখ্যায়িত করার মাধ্যমে এই চলমান বিভিন্নতার যৌক্তিকতা ও প্রয়োজন অবশ্যই মনে রাখা দরকার। বাংলা ভাষায় লিখিত সাহিত্য কেবল ভাষাগত পার্থক্যের কারণেই, যত সামান্য হোক, সর্বাংশে এক হবে না। ভাষার চেয়েও বিষয়বস্তুতে দুই অঞ্চলের মধ্যে যে ভিন্নতা, তা এখন সাদাচোখেই দেখা যায়। এর পেছনে রয়েছে আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক পটভূমির ভিন্নতা। এটা স্বাভাবিক। যেমন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য বা অস্ট্রেলিয়ায় লিখিত ইংরেজি সাহিত্যের ভাষা ও বিষয় এক নয়। কিন্তু এই পার্থক্যের ভেতরই ঐক্য হিসেবে কাজ করে ভাষা, তার সামান্য বিভিন্নতা সত্ত্বেও।

তিন স্থানেই—বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ ও অভিবাসীদের বসবাসের দেশসমূহ—বাংলা সাহিত্যের বিষয় এক হবে না, কিন্তু তাদের পরিচিতি হবে একই—বাংলা সাহিত্য।

এ জন্য তিনটি স্থানের সাহিত্যিকদের একে অন্যের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রাখা প্রয়োজন। তার চেয়েও বেশি প্রয়োজন নিজ নিজ উদ্যোগে গবেষণা, অনুশীলন ও চর্চা অব্যাহত রাখা। এ কথা জোর দিয়ে বলার প্রয়োজন নেই, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের আন্তর্জাতিক মর্যাদা ও গুরুত্ব নির্ভর করছে কোনো একটি ‘দেশের’ চর্চার ওপর নয়, বরং সবার পৃথক ও সমান্তরাল প্রচেষ্টার ওপর। অপ্রিয় সত্য কথা হলো, নতুন প্রজন্ম বাংলা ভাষা না শেখার কারণে বিদেশে অভিবাসীদের সাহিত্যচর্চা হয়তো একদিন শেষ হয়ে যাবে। তখন বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের বাংলাভাষীদের ওপরই বর্তাবে আন্তর্জাতিকতার মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখার দায়িত্ব। এর জন্য যে প্রস্তুতি, তা কি বাংলাদেশে নেওয়া হচ্ছে, তেমন কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে?

কেবল একাধিক দেশে চর্চার জন্যই বাংলা ভাষা ও সাহিত্য আন্তর্জাতিক—এ কথা বলা হলে তা আক্ষরিক অর্থে শোনাবে। ভাষা ও সাহিত্যের যে আন্তর্জাতিক মান, অলিখিত হলেও প্রাজ্ঞ পাঠক-সমালোচকের বোধ ও উপলব্ধিতে সেটি আছে। সেই বোধ ও উপলব্ধিকে সন্তুষ্ট করতে পারে, কয়েকটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে তেমন মানের কিছু বাংলা ভাষা ও সাহিত্য অর্জন করতে পেরেছে? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পর আর কোনো বাঙালি লেখক নোবেল তো দূরের কথা, অন্য কোনো বড় ধরনের আন্তর্জাতিক পুরস্কার যে পাননি, এ থেকে যদি মনে করা হয়, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য এখনো আন্তর্জাতিক মানের হয়ে ওঠেনি, তাহলে কি ভুল হবে? এ প্রশ্নগুলো নিয়ে কেউ কেউ বিতর্কে লিপ্ত হতে পারেন, তবে এসব প্রশ্নে ভাববার অবকাশ কিন্তু থেকেই যাচ্ছে।

আন্তর্জাতিক মানের হতে হলে দেশীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে সঙ্গে বিদেশি সাহিত্যের সাম্প্রতিক প্রবণতা ও বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে পরিচিত হওয়া প্রয়োজন। অধিকাংশ বাঙালি লেখক বিদেশি সাহিত্যের সঙ্গে এই যোগাযোগ রাখেন বলে মনে হয় না। এর ফলে বাংলা সাহিত্য একটি চক্রে বৃত্তাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। তাই বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে ‘আন্তর্জাতিক’ বলে দাবি করতে হলে কেবল ভৌগোলিক কারণ দেখিয়ে নয়, উন্নত মানের উৎকর্ষও অর্জন করা প্রয়োজন।

প্রথমআলো